Monday 5 December 2016

Sharodiya rod

কয়েক দিন ধরেই খুব মেঘ আর বৃষ্টি হয়ে চলেছিল । আর যখন একটু রোদের ছটা দেখতে পাচ্ছিলাম তখন মনে হচ্ছিলো জানলার রোদটা কেমন যেন সরে গেছে । কিন্তু এত কাজের ফাঁকে সেটা ভালো করে লক্ষ্য করার সময়ই হয়ে উঠছিল  না । প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো জানলার রোদের আসার তখনো  সময় হয়নি । আবার কখনও মনে হচ্ছিল যে হয়তো জানলায় রোদ এসে পড়ার সময় পেরিয়ে গেছে । কিন্তু আজ সকাল থেকেই দেখি এক গাল হাসি নিয়ে আকাশ ঝকঝকে করে সূর্য দেবতা হাজির হয়েছেন । তাই দেখে বেশ আনন্দিত হয়ে আলমারি থেকে আমার বিয়ের বেনারসীগুলো আর তার সঙ্গে আরো কিছু জামা কাপড় নিয়ে ছাদে ছুটলাম , রোদে দেওয়ার জন্য ।

রোদটা আমার গায়ে পড়তেই কেমন যেন একটু মনে হল । প্রথমে খেয়াল করিনি , মনে হল এত বর্ষার পর রোদ উঠেছে বলেই হয়তো আমার অন্য রকম লাগছে আজকের সূর্য দেবতার হাসিকে । যেদিকে সচরাচর সূর্য দেবতাকে দেখতে আমি অভ্যস্ত , আজ সেই দিকে তিনি নেই । কিন্তু কিছুক্ষন বাদেই বুঝলাম এ যে -সে রোদ নয় , এ হচ্ছে আমাদের মন খুশি করে দেওয়ার রোদ । সারা বছর ধরে আমরা বাঙালীরা অধীর আগ্রহে যে রোদের অপেক্ষায় থাকি , এ হচ্ছে সেই রোদ । শুধু বাঙালী কেন , আজকাল জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এই রোদ এর আনন্দে মেতে ওঠে । এ হলো আমাদের সবার প্রিয় শারদীয়া রোদ

শারদীয়া রোদ এসেছে , ভেবেই আনন্দে মন নেচে  উঠলো । নিজের মনেই একা-একা দাঁড়িয়ে হেসে উঠলাম । জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখলাম ভালো করে । এই রোদ এর সঙ্গে এক সোনালি আভা মিশে আছে । যেন হলুদ আর সোনালী রং এর  দুই শিশু হাত ধরাধরি করে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে । আর সেই খেলার ছলে গাছপালা-ঘরবাড়ির প্রত্যেকটা কোণ ছুঁয়ে যাচ্ছে । নিজেদের রঙে রাঙিয়ে দিচ্ছে , আর তারপরই খিলখিল হাসিতে হেসে উঠছে দুজনেই । কি অপরূপ সেই দৃশ্য । আমি শুধুই মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেই সব দেখছি আর মনে হচ্ছে যেন আমার মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা শিশু তাদের সঙ্গে খেলতে চাইছে , ছুটে  যেতে চাইছে তাদের হাত ধরে । আবার নিজের মন-শিশুর কথা বলতেই মনে পড়ে  গেল সেই ছেলেবেলার কথা । এই রোদ দেখে যত আনন্দ পেতাম ,ততটা দুখীও হতাম । পুজো আসার এক তুমুল আনন্দ , আর তার সঙ্গেই জড়িয়ে থাকত পরীক্ষার সময় হয়ে আসার এক ভয় ,দুঃখ ,কষ্ট ,হতাশা । মনে হত  যেন শুধু আনন্দের রোদকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারলে বেশ ভালো হত । আমার পড়ার বিছানার পাশেই জানলা ছিল । ঠিক জানলার পাশেই ছিল একটা পেয়ারা গাছ , কত রকমের পাখি আসত আর আমাকে কত কথা বলে যেত । কেউ কেউ আবার গান ও শুনিয়ে যেত । আমি তাদের কোনোকিছুই ঠিক বুঝতে পারতাম না । কিন্তু এই শরৎকালে তাদের ভাষা যেন আমি বুঝতে পারতাম । মনে হত তারা যেন শারদ শুভেচ্ছা জানাতে এসেছে । মাঠে কত কাশফুল ফুটেছে সেটা জানাতে এসেছে । চারদিকের ম-ম করে ওঠা শিউলি ফুলের গন্ধে তারা যে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে সেটা জানাতে এসেছে । তার সঙ্গে হাত ধরে নিয়ে এসেছে দুস্টু শারদীয়া রোদকে ,আমার ঠিকানা চিনিয়ে দিয়ে । মন ভরে সেই মিষ্টি শারদীয়া রোদকে দেখতাম আর তার সঙ্গে সেই পাখিদের কতই না গান-গল্প শুনতাম । তাদের ওই কলধ্বনিতে আমি যেন ঢাকের আওয়াজ শুনতে পেতাম । চোখের সামনে ভেসে উঠত হাওয়ায় দোল খেতে থাকা মাঠ ভর্তি কাশফুল। আর গন্ধ পেতাম শিউলি ফুলের । মনে হত সেই পেয়ারা গাছের ফাঁক দিয়ে শারদীয়া রোদ হাতছানি দিয়ে আমায় ডাকছে । সে আমার সাথে খেলতে এসেছে । ভীষণ দুস্টু , একদম পড়াশোনা করতে দেবে না সে । কি রকম খিলখিল করে হাসছে আমার ওপর । সে উন্মুক্ত , খোলা আকাশে যখন যেখানে খুশি যেতে পারে । নেই কোনো পরীক্ষা আর পড়াশোনার বালাই । "ইশ , এবার খুব রাগ হচ্ছে আমার ওর ওপর "। আমার সঙ্গে খেলতে এসে আমাকে নিয়েই ঠাট্টা করছে । রোজ সকালে আসছে আজকাল , দুপুরেও আসছে রোজ । আর আমি অপেক্ষা করতাম পরীক্ষা শেষ হওয়ার । আর মনে করে নিতাম আমার নতুন জামাকাপড় গুলোকে । ঠিক করে নিতাম পুজোর কোন দিন কোনটা পড়ব। সঙ্গে ম্যাচিং গয়নাও । কিন্তু পরীক্ষা খারাপ দিলে সব প্ল্যানিং ভেস্তে যাবে । এই ভেবে একটু ভয়  পেতাম ঠিকই , কিন্তু শারদ রোদ এর সম্মোহনে পরীক্ষার ভয় ভুলে গিয়ে আবার নিজের কল্পনার দেশে চলে যেতাম । কত কি ভাবতাম আর ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়তাম বই এর ওপর ।

ঘুম ভাঙত এক মিষ্টি নারী কণ্ঠে । খুব আদর করে,মাথায় হাত বুলিয়ে ,কে যেন কানের কাছে এসে বলত "এবার উঠে পর " । ঘুমের ঘোরে মনে হত যেন মা দূর্গা এসেছেন ,আমাকে সেই দুস্টু শারদীয়া রোদের সাথে ভাব করিয়ে দিতে । চোখ খুলে দেখি আমার মা দাঁড়িয়ে আছেন আর আমাকে আবার পড়তে বসতে বলছেন । বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি দুস্টু রোদ তখনও খেলা করে চলেছে । আমায় আবার হতাশ মনে বই এর মধ্যে মুখ গুঁজলাম । হঠাৎ কেউ যেন পেছন থেকে ডেকে উঠল । পিছন ফিরতেই দেখি আরেকটা আমি জানলার সামনে দাঁড়িয়ে , কিন্তু তার হাতে কোনো বই নেই, নেই পরীক্ষা দেওয়ার কোন চিন্তা । আমি এখন সেই আলমারির জামাকাপড় হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে । এখনও সব রোদে দেওয়া শেষ হয়নি । আনন্দের ঘোর কাটিয়ে ফিরে এলাম বাস্তব জগতে । আর একটু হাসিই পেল নিজের ওপর । আমি বড় হয়ে গেলাম , কাজের ধরনও বড় হয়ে গেল। কিন্তু শারদীয়া রোদ চিরকাল সেই একই রকম থেকে গেল ,সেই একই দুস্টু শিশু । ছোটবেলায় আমাকে পরীক্ষার সময় যেভাবে নিজের মায়াজালে জড়িয়ে ফেলত, এখনো ঠিক সেই একইরকম ভাবে আমার সাথে খেলা করছে । ভীষণ দুস্টু এই শারদীয়া রোদ ,তবু সারাবছর অপেক্ষা করে থাকি এর জন্যে ।

আর সময় নেই, অনেক কাজ পরে আছে । ছুটে গেলাম আবার আমার নিত্য নৈমিত্তিক জীবনে ।