Saturday 25 February 2017

আমার প্রিয় বন্ধু

আমাদের সবারই জীবনে এক বা একাধিক প্রিয় বন্ধু থাকেই । যদিও আজকাল সে রকম অর্থে প্রকৃত বন্ধু খুঁজে পাওয়া একটু অসম্ভব হয়ে গেছে । সেটা অবশ্য আমার লেখার বিষয়বস্তু নয় । আমি এখানে বলতে চাই আমার এক প্রিয় বন্ধুর ব্যাপারে , সঙ্গীতা । আমাদের আলাপ হয় এক গার্লস্ স্কুলে । আমার জীবনের প্রথম আর শেষ গার্লস্ স্কুল । তাই অনেকটাই বাঁধনছাড়া গরুর মত অবস্থা হয়েছিল আমার । তার ওপর সঙ্গীতাকে পেয়ে আরও মেতে উঠেছিলাম । ওর মত মেয়ে আমি আমার জীবনে দেখিনি বললেই চলে । এত আনন্দ আর হইহুল্লোর করত যে পুরো ক্লাসকে মাতিয়ে রাখত । ওর সঙ্গে স্কুল জীবনে আমি এমন অনেক কাজ করেছি যেগুলো ওকে পাওয়ার আগে আমি কোনোদিন করব বলে কল্পনাতেও ভাবিনি । ওর সঙ্গে বসে , স্কুলের সব থেকে রাগী টিচারের ক্লাসে বসে পেয়ারা আর কুল খাওয়া আজও মনে পড়ে যায় । গন্ধে পুরো ক্লাস ভরে যেত , কি ভয়টাই না হত । এই বুঝি ধরা পড়ে যাব ভেবে । একবার প্রায় ধরাও পড়তে যাচ্ছিলাম । সে যাত্রা সেই বাঁচিয়েছিল নিজের ওপর দোষ নিয়ে । যদিও বকুনিটা ঐ বেঞ্চের সবার কপালেই জুটেছিল । বেঞ্চে দাঁড়িয়ে ষাঁড় চিৎকার করে গান গাওয়া আর সঙ্গে উন্মাদ নৃত্য । স্কুলের বড়দিদিমণিকে প্রায় দিনই আসতে হত আমাদের ক্লাসে , বকুনি আর সাবধানবার্তা দিতে । ক্লাস মনিটরের কাছেও কম ধমকি খেতাম না । কিন্তু বাগে আর আনতে পারত না কেউই । আমাদের ক্লাসরুমের বাইরের দিকে তখন কোনও দেওয়াল বা বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল না , মানে জানলার বাইরেই কয়েকহাত পর রাস্তা ।  সেই জানলা দিয়ে সঙ্গীতা আর আমার আর সঙ্গে আরও কয়েকজনের চলত নিয়মিত আদান-প্রদান .... আইস্ক্রীম , বরফ , ঝালমুড়ি কেনা , থাকত তেঁতুল মাখাও । তার এইরকম পাগলামি চলত টিউশন ক্লাসেও । আমি সেখানেও বেশ সঙ্গ দিতাম । পড়তে-পড়তে হঠাৎ পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে রাস্তার ধারের খেজুর গাছ থেকে খেজুর পাড়া  বা সেই টিউশন স্যারেরই উঠোনের আম গাছ থেকে আম পাড়া । সব নিয়ে এসে এক জায়গায় এনে রাখত সে । একা কখনই সে ঐসব খেত না , সবার মধ্যে ভাগ করে খেতেই পছন্দ করত । এমনকি স্যারকেও দেওয়া হত । তাই রাগ না কমিয়ে আর উপায়ও থাকত না স্যারের । দিনের বেশীরভাগ সময়টাই আমরা একসাথে থাকতাম । সারাদিন অগুন্তি কথা চলত আমাদের । অত কথার মধ্যে যদি ভুল করেও কোনও কথা বাদ চলে যেত তাহলে সেই রাতটা যেন আরও লম্বা হয়ে যেত কাটাতে । কিন্তু সময়ের সাথে সব পাল্টাতে থাকল । আমরা একসাথে একই জায়গা থেকে পড়াশোনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েও শেষ পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি । যোগাযোগ বলতে লম্বা ছুটির সময় বাড়ি গেলে আমাদের কয়েকঘন্টার দেখা । সেই সময় এতই কম হত যে সব কথা বলাও হত না । অনেক কথা না-বলা হয়েই থেকে যেত । তারপর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংগুলোর কৃপায় আমাদের যোগাযোগের মাধ্যমটা আর একটু বাড়ল । কিন্তু কিলোমিটারে দুরত্ব বাড়ার যে একটা প্রভাব থাকে , সেটা বুঝতে পারি যখন সেই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটেই এক অজানা ছেলের কাছ থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট আসে এই বলে যে সে নাকি এখন সঙ্গীতার জীবনের স্পেশ্যাল মানুষ হয়ে উঠেছে । সারাদিন তখন আমাদের বেশ ভালই কথা হত , এত ভাল বন্ধু আমরা যে দুরে থেকেও একে অপরকে সব বলতাম । অথচ সেদিন অন্য লোকের থেকে তার ব্যাপারে এত ভাল একটা খবর জানতে হয়েছিল বলে বেশ একটু রেগেই গিয়েছিলাম । মান অভিমানের পালাও চলেছিল বেশ কয়েকদিন । তারপর অবশ্য আবার সব আগের মত হয়ে গিয়েছিল । মাঝেমধ্যে আমরা তিনজনেই বেশ আড্ডা দিতাম ফোনে বা সাইটে । ওদিকে থাকত ওরা দুজন , আর এদিকে আমি । ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত আড্ডায় । পরীক্ষার জন্য মাঝেমধ্যেই একটু বেশীই গ্যাপ পরে যেত আমাদের । ওর জন্মদিন ছিল , শুভেচ্ছা জানানোর জন্য তাই ফোন করলাম ,  ওপার থেকে একটা মেয়ের গলা । কিন্তু সে যে আমার সঙ্গীতার গলা নয় । কে সে ? কেনই বা সঙ্গীতার ফোন ধরে সঙ্গীতাকে ডেকে দিতে বললেও দিচ্ছে না । কি বিচ্ছিরি একটা হাসি হেসে বলল যে সে কোনো সঙ্গীতাকে চেনে না । সোশ্যাল সাইটে সঙ্গীতাকে যোগাযোগ করতে গিয়ে দেখি তার প্রোফাইলটাও নেই । আবার সঙ্গীতার সাথে যোগাযোগ কেটে গেল । সেই তিনমাসে কি হয়েছিল তা আজও জানিনা , কোনোদিন জানার চেষ্টাও করিনি । ভেবেই নিয়েছিলাম যে সেটা তার খুব পার্সনাল ব্যাপার । কিন্তু যোগাযোগ করার চেষ্টা খুব করেছিলাম , নিজের রাগটা ঝারব বলে । তাই তার স্পেশ্যাল মানুষটিকে মেইল করে ওর ব্যাপারে খোঁজ নিতে বাধ্য হয়েছিলাম । শুনলাম তার সঙ্গেও নাকি যোগাযোগ নেই আর । কিছুটা ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম । ছুটিতে বাড়ি গিয়েই তাই ছুটেছিলাম ওর বাড়িতে । কাকিমার কাছে একটা নম্বরও পেয়েছিলাম , আর একটু স্বস্তিও । কিন্তু ওটাতেও শুধু তখনই কথা বলা গেল । কাকিমার সামনে বেশী কিছুই বলতে পারিনি তখন । সে বলেছিল দেখা হলে নাকি অনেক কিছু বলবে । তারপর অনেক চেষ্টা করেও আর যোগাযোগ করতে পারিনি সেই নম্বরে । ভেবে নিয়েছিলাম যে ও হয়তো আমাকে আর প্রিয় বন্ধু হিসেবে দেখে না । সময়ের সাথে তো অনেক কিছুই পরিবর্তন হতে থাকে , এটাও একরকম তাই । ততদিনে আমার বাবার ট্রান্সফার হয়ে যায় । আর আমরা ঐ জায়গা ছেড়ে চলে আসি । সব ভুলে যাই সময়ের সাথে । আমার জন্মদিন । সকালে উঠেই মনে পড়ে গেল সঙ্গীতার কথা । পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকত না কেন , এই দিনটায় ও আমাকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানাতই । কিছুক্ষন পরেই ফোন আসে এক অজানা নম্বর থেকে , পুরুষকন্ঠ । পাশ থেকে একটা মেয়ের গলায় কেউ হাসছে খুব , চেনা হাসি । পুরুষকন্ঠে যিনি কথা বলে যাচ্ছিলেন তাঁর কোনো কথাই আমি মন দিয়ে তখন শুনছিলাম না । তাঁর কথা থামিয়ই বলে উঠেছিলাম "পাশে সঙ্গীতা হাসছে না?" । ফোনটা এবার তিনি পাশের মেয়েটিকে দিয়ে দিলেন । ওপাশ থেকে হাসি থামিয়ে মেয়েটি বলল , "হ্যালো" । সঙ্গীতা । প্রচন্ড রাগ হল আমার আর গলার কাছে যেন সব কথা আটকে গেল । কিছুক্ষন পর ধাতস্থ হয়েই আমি আমার নালিশের সিন্দুক খুলে বসে পড়লাম । সেও যে খুব দুঃখ প্রকাশ করল । বলল যে সে নাকি বিয়ে করেছে । ঐ পুরুষকন্ঠের ব্যক্তিই নাকি তার স্বামী । ভীষণ খুশি হয়ছিলাম , আবার রাগও হয়েছিল খুব । বিয়ে করে নিল আর আমার নম্বর জানা সত্ত্বেও আমাকে একবার জানাল না ?!! যাই হোক , আমাদের আবার যোগাযোগ তো হল । আর সে নতুন জীবনে পা রেখেছে । এই ভেবে আর বেশী কিছু বলতেও পারলাম না । কিন্তু সম্পর্কে একবার ভাঙন ধরলে যে তা আর আগের মত হওয়ার নয় । আমার বিয়ের সময় আবার আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় । আর এইবার আমি যে খুব একটা চেষ্টা করেছিলাম যোগাযোগের তাও নয় । মনে হয়েছিল সেও তো আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করেছে , আমি করলেই বা দোষ কি ? আমার সেই ভাবনায় মন খারাপ হয়েছিল কি না জানি না , বা হয়ে থাকলেও যে খুব হয়েছিল তা মনে হয় নয় , কিন্তু রাগটা বেশ খানিকটা কমে গিয়েছিল । বিয়ে করে শশুরবাড়ি আসার পর অবশ্য স্কুলের কিছু বন্ধুদের দৌলতে আবারও আমাদের যোগাযোগ হয় । এবার অবশ্য ঝগড়া নয় , কেমন যেন দুরত্ব চলে এসেছিল আমাদের মধ্যে । চেষ্টা করেও তা কমানো যায়নি । না বললে নিজেকেই অপরাধী মনে হবে .... এবার দুরত্বটা ছিল কিছুটা আমার দিক থেকেই । সঙ্গীতা চেষ্টা করেছিল সবটা আগের মত করে নেওয়ার । এইবার আমি আর নিজের ব্যাপারের সব কথা চেষ্টা করেও বলতে পারতাম না ওকে । তার ওপর মাঝেমাঝেই আমি একটু বকাবকি করে ফেলতাম । বেচারী সবই চুপ করে মেনে নিত । আমাদের মাঝেমধ্যে কথা হত । আমার বাড়িও আসবে বলেছিল । বলেছিল যে সামনে বসে আমার বকুনি শুনবে । আর আমদের সম্পর্কটা আবার আগের মত করে দেবে । কিন্তু সে সময় আর এল না । একদিন এক বন্ধুর ফোন এল .... সে বলল যে সঙ্গীতা আর নেই । আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম । দু'দিন আগেই সে আবারও বকা খেয়েছিল । নেই মানে? আবার না বলে পালাল সে? এবার সে অনেক দুরে পালিয়ে গেল যে !!! কয়েকদিন ধরে তার নাকি খুব শরীর খারাপ ছিল । সেটাও সে বলেনি কাউকে । আর তাঁকে কোনোদিন খুঁজেও পাব না । এভাবে আবার ছেড়ে যাওয়ার জন্য আর ঝগড়াও করতে পারব না । আমার রাগ , ঝগড়া , অভিমান , বকুনি সবকিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সে আজ অনেক দুরে । ওখানে তো কোনও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট পৌঁছোয় না । আর কোনোদিন তাঁকে খুঁজে পাব না । আমার জন্মদিনে আর তাঁর ফোনও আসবে না । এখনও মনে হয় সে হয়ত আবার কয়েকদিন পর ফিরে আসবে ।
আমি আগেও চাইতাম , এখনও চাই .... তুই যেখানেই থাকিস , ভাল থাকিস । 

Saturday 11 February 2017

মুন্নী ও ফুচকাওয়ালা

ছোটোবোলায় অনেকে "কাবুলীওয়ালা"-র গল্পটা শুনেছে , পড়েছে বা সিনেমাতে দেখেও থাকতে পারে । আমি যেমন সিনেমাতে দেখেছিলাম । তখন খুউব ছোটো আমি । সিনেমা দেখার অদ্ভুত নেশা ছিল । যদিও হল-এ গিয়ে কোনোদিন সিনেমা দেখার সুযোগ হয়নি । কি করেই বা দেখব , সেখানে তো কোনও হলই ছিল না । তাই সবকিছু টেলিভিশনেই দেখতাম । ওতেই দেখেছিলাম এই "কাবুলীওয়ালা" সিনেমাটা । খুব মনে ধরেছিল গল্পটা । কারণ, কোথাও না কোথাও আমার জীবনের সাথে একটু সাদৃশ্য পেয়েছিলাম । যদিও আমার গল্পের পরিণতি ছিল একটু অন্যরকম । আসলে আমাদের সবারই জীবনে এই রকম কেউ না কেউ থাকে । কিন্তু এই ব্যস্ত জীবনে , সমযে়র অভাবে সেইসব মানুষের কথা মনে করার মত ফুরসতটুকু আমাদের থাকে না । তবুও মাঝেমধ্যে তো মনে পরেই যায় । আমার জীবনে অবশ্য এরকম প্রচুর মানুষ আছে । এখনও শ্যামবাজার-হাতিবাগানে গেলে এই মেসবাসী মেয়ের তিন-চার জন কাকু-দাদা তো পেয়েই যাব । কিন্তু এই রকম "ওয়ালা" ছিল একজনই , আমার ছোটোবেলার "ফুচকাওয়ালা" । কিন্তু আমার কাছে "ফুচকাচাচা" । আমার আগের লেখায় তার ব্যাপারে অল্প বলেছিলাম । কিন্তু এইসব মানুষদের নিয়ে ঐটুকু বলে শেষ করে দিলে তা খুবই খারাপ হবে । নিঃস্বার্থভাবে যারা কোনো সম্পর্ক ছাড়াই খুব সহজে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে , রেখে যায় অজস্র স্মৃতি , মন ভাল করে দেওয়া অনেকগুলো মুহূর্ত তাদের ব্যাপারে একটু বেশী বললেই বা ক্ষতি কি ।
আমি ছোটোবেলায় যেখানে থাকতাম , সেটা ছিল বাংলা-বিহার সীমানার কাছাকাছি । তখনও ঝারখণ্ড হয়নি , শুধু বিহারই ছিল । জেলা হিসেবে সে জায়গা বাংলার অধীনে থাকলেও সেখানকার বেশীরভাগই ছিলেন হিন্দীভাষী । প্রায়ই অবাঙালী জায়গাই বলা যেতে পারে । আমিও তাই বাঙালী হয়েও ছোটো থেকে হিন্দীতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম । তাই 'ফুচকাওয়ালা'কে 'চাচা' বলতেই বেশী ভালবাসতাম । আর সেও ভীষণ খুশী হত আমার 'চাচা' ডাকে । ভালবেসে চাচাও অবশ্য আমাকে একটা নাম দিয়েছিল , "মুন্নী" । সেই নামে আমাকে আর কখনও কেউ ডাকেনি । দূর থেকে তার এই ডাক শুনেই আমি তার দিকে ছুট লাগাতাম । ছুটে যাব নাই বা কেন , সেই ডাকে যে থাকত খুব আন্তরিকতা । স্কুলের বাইরে সে দাড়াত । রোদ , বৃষ্টি , ঠান্ডা .. যাই হোক না কেন , সে কিন্তু আসবেই । সকালে স্কুলে ঢুকবার আগে থেকে স্কুল ছুটি হওয়ার পরেও , সে যখন আমার বাড়ির সামনে দিয়ে নিজের বাড়ী ফিরত তখন পর্য্যন্ত আমাদের মধ্যে চলত আদান-প্রদান । না-না , শুধু ক্রেতা-বিক্রেতার আদান-প্রদান নয় , চলত স্নেহ ও ভালোবাসারও । আর আমার ফুচকা খাওয়ার তো কোনও শেষ ছিল না বললেই চলে । আমি শেষ বেলা পর্য্যন্ত ছুটতাম তার কাছে ফুচকা খাওয়ার জন্য । তখন ১ টাকায় ৩টে করে ফুচকা পাওয়া যেত । টাকা দিয়ে খেয়েও  "ফাউ" এর আবদার তো থাকতই । শুধুই কি ফুচকা ... তার সঙ্গে মাঝেমাঝেই থাকত তেঁতুলমাখা , শুকনো পাপড়ি , কাঁচাছোলা , ফুচকার তেঁতুলগোলা জল । আর সেই সব কিছুই থাকত বিনামূল্যে । ক্লাস শেষ হলে টিচার বেরিয়ে যেতেই আমরা জানলা থেকে হাত বাড়িয়ে দিতাম ... ফরমাইশ হত তেঁতুল মাখার । চাচা যেন আগে থেকেই সেটা বুঝে যেত , হাত বাড়াতেই জুটে যেত শালপাতায় মোড়া তেঁতুলমাখা । সঙ্গে হাসিমুখে একটা কথা "হমকা মালুম থা মুন্নী" । ছুটির পর প্রায় মারামারি করে তার ঠেলার ওপর গিয়ে হামলে পড়া । এমনভাবে খেতাম , মনে হত যেন কতদিন কিছু খাবার জোটেনি । স্কুলে ছুটির দিনগুলোতে চাচা মার্কেটে বসত । বিকেলে বাড়িফিরতি পথে আমার বাড়ির সামনে দিয়ে খুব বাসন বাজাতে-বাজাতে যেত । মা কে বলে আমি থালা , বাটি আর গ্লাস হাতে রেডী হয়ে থাকতাম । এই ব্যাপারে অবশ্য আমার মা ও কিছু কম যান না । কোনো কারণে আমি সেই সময় না থাকলে বা ঘুমিয়ে পড়লে মা-ই ছুটত ফুচকা নিতে । আমাকে না পেলে চাচা তার মুন্নীর খোঁজ করতেও ভুলত না ।
দূর্গাপূজোর সময় হত আর এক ঝামেলা । আমার বছর ঘুরত দুর্গাপূজো দিয়ে । সারা বছর ধরে পূজোর জন্য টাকা জমা করতাম । আর তার কারণ ছিল একটাই , ঐ চাচার ঠেলার মুখরোচক খাবার ... পানি ফুচকা , স্পেশাল ফুচকা , আলু কাবলী , ঘুগনী চাট । বলতে গিয়ে এখনও আমার জিভে জল চলে আসে । ঐসব খাওয়ার জন্য যে টাকা আমি জমাতাম , তখন তার হিসেবও করতে জানতাম না । এই ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করেই ঘরে চলত তুমুল ঝামেলা । আমার বাবা ভাবতেন যে যেহেতু তার মেয়ে হিসেব কষতে পারে না , তাই সে ঠকে আসবে । তাই আমাকে নিয়ে হিসেব বোঝাতে আর মেলাতে বসতেন ... কটা ফুচকা খেয়েছি , সঙ্গে আর কি কি খেয়েছি ওখান থেকে , কত টাকা দিয়েছি , কত ফেরত পেয়েছি , কার কত দাম । সব শেষে হিসেব করতে গিয়ে দেখা যেত যে তার মেয়ে নয় , ঠকেছে বরং সেই 'ফুচকাওয়ালা' , তাঁর মেয়ের চাচা । বাবা পরে টাকা দিতে গেলে চাচা নিতেও চাইত না ।
একদিন চাচা তার ছেলেকে নিয়ে এল । চাচার নাকি বয়স হয়ে যাচ্ছে , আর পারে না ঠেলা টানতে । তার ছেলেকে আমাদের সবাইকে চিনিয়ে দিল । চাচাও সঙ্গে আসত । আমরা গেলে চাচাই ফুচকা বানিয়ে দিত । বাকি সময়টা সে বসেই থাকত । এইভাবেই বেশ কয়েক মাস যাবার পর চাচা আসা বন্ধ করে দিল । মাঝেসাঝে আসত , তাও বেশীক্ষণ না থেকেই চলে যেত । তার নাকি শরীর ভাল থাকে না । চাচা না এলে ফুচকাতে যেন পেতাম না সেই স্বাদ । ফুচকা খাওয়ার ইচ্ছে , আনন্দ কমতে থাকল । চাচার ছেলেকে আমরা "ভাইয়া" বলতাম । ভইয়াও সেইসবই করত যা চাচা করত , তবুও যেন কিছু একটা কম লাগত । চাচার সেই স্নেহ ভরা "মুন্নী" ডাক , আদুরে গলায় খুনসুটি সবকিছুই চাচার শরীরের মত অসুস্থ হয়ে এল । ভাইয়ার কাছে রোজই চাচার খোঁজ করতাম , আর রোজ একই কথা বলত ভাইয়া যে ভাল নেই আরও অসুস্থ হয়ে পরছে । একদিন ভাইয়াও এল না । কি অদ্ভুতভাবে ফুচকার ঠেলাটা সেদিন দেখতে না পেয়ে কেমন একটা ভয় হয়েছিল , প্রথমবার হল ওরকম । কয়েকদিন পর ভাইয়া ফিরতেই ছুটে গেছিলাম তার না আসার কারণ জানতে আর সঙ্গে চাচার খোঁজ নিতে । চাচা নাকি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল । তারপর থেকে মাঝেমধ্যেই ঐ ফুচকার ঠেলাটা আসত না , যেন সেও তার মালিকের জন্য চিন্তিত । যতদিন ওখানে ছিলাম এইভাবেই দেখে গেলাম । তারপর বাবার ট্রান্সফার হয়ে গেল আর আমরাও নতুন জায়গায় চলে গেলাম । বন্ধুদের কাছে পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিলাম যে 'ফুচকাওয়ালা' নাকি চিরবিদায় নিয়েছে । বিশ্বাস হয়নি , আজও হয়না । মনে হয় যেন ভূল খবর শুনেছিলাম বা ওরা ভূল খবর পোয়েছিল । সেখানে গেলে হয়তো আজও "ফুচকাওয়ালা"কে ঐভাবেই ঠেলার ওপারে দাঁড়িয়ে থেকে ফুচকা বিক্রি করতে দেখব । সেও তার মুন্নীর জন্য অপেক্ষা করে আছে হয়তো ।