Saturday 11 February 2017

মুন্নী ও ফুচকাওয়ালা

ছোটোবোলায় অনেকে "কাবুলীওয়ালা"-র গল্পটা শুনেছে , পড়েছে বা সিনেমাতে দেখেও থাকতে পারে । আমি যেমন সিনেমাতে দেখেছিলাম । তখন খুউব ছোটো আমি । সিনেমা দেখার অদ্ভুত নেশা ছিল । যদিও হল-এ গিয়ে কোনোদিন সিনেমা দেখার সুযোগ হয়নি । কি করেই বা দেখব , সেখানে তো কোনও হলই ছিল না । তাই সবকিছু টেলিভিশনেই দেখতাম । ওতেই দেখেছিলাম এই "কাবুলীওয়ালা" সিনেমাটা । খুব মনে ধরেছিল গল্পটা । কারণ, কোথাও না কোথাও আমার জীবনের সাথে একটু সাদৃশ্য পেয়েছিলাম । যদিও আমার গল্পের পরিণতি ছিল একটু অন্যরকম । আসলে আমাদের সবারই জীবনে এই রকম কেউ না কেউ থাকে । কিন্তু এই ব্যস্ত জীবনে , সমযে়র অভাবে সেইসব মানুষের কথা মনে করার মত ফুরসতটুকু আমাদের থাকে না । তবুও মাঝেমধ্যে তো মনে পরেই যায় । আমার জীবনে অবশ্য এরকম প্রচুর মানুষ আছে । এখনও শ্যামবাজার-হাতিবাগানে গেলে এই মেসবাসী মেয়ের তিন-চার জন কাকু-দাদা তো পেয়েই যাব । কিন্তু এই রকম "ওয়ালা" ছিল একজনই , আমার ছোটোবেলার "ফুচকাওয়ালা" । কিন্তু আমার কাছে "ফুচকাচাচা" । আমার আগের লেখায় তার ব্যাপারে অল্প বলেছিলাম । কিন্তু এইসব মানুষদের নিয়ে ঐটুকু বলে শেষ করে দিলে তা খুবই খারাপ হবে । নিঃস্বার্থভাবে যারা কোনো সম্পর্ক ছাড়াই খুব সহজে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে , রেখে যায় অজস্র স্মৃতি , মন ভাল করে দেওয়া অনেকগুলো মুহূর্ত তাদের ব্যাপারে একটু বেশী বললেই বা ক্ষতি কি ।
আমি ছোটোবেলায় যেখানে থাকতাম , সেটা ছিল বাংলা-বিহার সীমানার কাছাকাছি । তখনও ঝারখণ্ড হয়নি , শুধু বিহারই ছিল । জেলা হিসেবে সে জায়গা বাংলার অধীনে থাকলেও সেখানকার বেশীরভাগই ছিলেন হিন্দীভাষী । প্রায়ই অবাঙালী জায়গাই বলা যেতে পারে । আমিও তাই বাঙালী হয়েও ছোটো থেকে হিন্দীতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম । তাই 'ফুচকাওয়ালা'কে 'চাচা' বলতেই বেশী ভালবাসতাম । আর সেও ভীষণ খুশী হত আমার 'চাচা' ডাকে । ভালবেসে চাচাও অবশ্য আমাকে একটা নাম দিয়েছিল , "মুন্নী" । সেই নামে আমাকে আর কখনও কেউ ডাকেনি । দূর থেকে তার এই ডাক শুনেই আমি তার দিকে ছুট লাগাতাম । ছুটে যাব নাই বা কেন , সেই ডাকে যে থাকত খুব আন্তরিকতা । স্কুলের বাইরে সে দাড়াত । রোদ , বৃষ্টি , ঠান্ডা .. যাই হোক না কেন , সে কিন্তু আসবেই । সকালে স্কুলে ঢুকবার আগে থেকে স্কুল ছুটি হওয়ার পরেও , সে যখন আমার বাড়ির সামনে দিয়ে নিজের বাড়ী ফিরত তখন পর্য্যন্ত আমাদের মধ্যে চলত আদান-প্রদান । না-না , শুধু ক্রেতা-বিক্রেতার আদান-প্রদান নয় , চলত স্নেহ ও ভালোবাসারও । আর আমার ফুচকা খাওয়ার তো কোনও শেষ ছিল না বললেই চলে । আমি শেষ বেলা পর্য্যন্ত ছুটতাম তার কাছে ফুচকা খাওয়ার জন্য । তখন ১ টাকায় ৩টে করে ফুচকা পাওয়া যেত । টাকা দিয়ে খেয়েও  "ফাউ" এর আবদার তো থাকতই । শুধুই কি ফুচকা ... তার সঙ্গে মাঝেমাঝেই থাকত তেঁতুলমাখা , শুকনো পাপড়ি , কাঁচাছোলা , ফুচকার তেঁতুলগোলা জল । আর সেই সব কিছুই থাকত বিনামূল্যে । ক্লাস শেষ হলে টিচার বেরিয়ে যেতেই আমরা জানলা থেকে হাত বাড়িয়ে দিতাম ... ফরমাইশ হত তেঁতুল মাখার । চাচা যেন আগে থেকেই সেটা বুঝে যেত , হাত বাড়াতেই জুটে যেত শালপাতায় মোড়া তেঁতুলমাখা । সঙ্গে হাসিমুখে একটা কথা "হমকা মালুম থা মুন্নী" । ছুটির পর প্রায় মারামারি করে তার ঠেলার ওপর গিয়ে হামলে পড়া । এমনভাবে খেতাম , মনে হত যেন কতদিন কিছু খাবার জোটেনি । স্কুলে ছুটির দিনগুলোতে চাচা মার্কেটে বসত । বিকেলে বাড়িফিরতি পথে আমার বাড়ির সামনে দিয়ে খুব বাসন বাজাতে-বাজাতে যেত । মা কে বলে আমি থালা , বাটি আর গ্লাস হাতে রেডী হয়ে থাকতাম । এই ব্যাপারে অবশ্য আমার মা ও কিছু কম যান না । কোনো কারণে আমি সেই সময় না থাকলে বা ঘুমিয়ে পড়লে মা-ই ছুটত ফুচকা নিতে । আমাকে না পেলে চাচা তার মুন্নীর খোঁজ করতেও ভুলত না ।
দূর্গাপূজোর সময় হত আর এক ঝামেলা । আমার বছর ঘুরত দুর্গাপূজো দিয়ে । সারা বছর ধরে পূজোর জন্য টাকা জমা করতাম । আর তার কারণ ছিল একটাই , ঐ চাচার ঠেলার মুখরোচক খাবার ... পানি ফুচকা , স্পেশাল ফুচকা , আলু কাবলী , ঘুগনী চাট । বলতে গিয়ে এখনও আমার জিভে জল চলে আসে । ঐসব খাওয়ার জন্য যে টাকা আমি জমাতাম , তখন তার হিসেবও করতে জানতাম না । এই ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করেই ঘরে চলত তুমুল ঝামেলা । আমার বাবা ভাবতেন যে যেহেতু তার মেয়ে হিসেব কষতে পারে না , তাই সে ঠকে আসবে । তাই আমাকে নিয়ে হিসেব বোঝাতে আর মেলাতে বসতেন ... কটা ফুচকা খেয়েছি , সঙ্গে আর কি কি খেয়েছি ওখান থেকে , কত টাকা দিয়েছি , কত ফেরত পেয়েছি , কার কত দাম । সব শেষে হিসেব করতে গিয়ে দেখা যেত যে তার মেয়ে নয় , ঠকেছে বরং সেই 'ফুচকাওয়ালা' , তাঁর মেয়ের চাচা । বাবা পরে টাকা দিতে গেলে চাচা নিতেও চাইত না ।
একদিন চাচা তার ছেলেকে নিয়ে এল । চাচার নাকি বয়স হয়ে যাচ্ছে , আর পারে না ঠেলা টানতে । তার ছেলেকে আমাদের সবাইকে চিনিয়ে দিল । চাচাও সঙ্গে আসত । আমরা গেলে চাচাই ফুচকা বানিয়ে দিত । বাকি সময়টা সে বসেই থাকত । এইভাবেই বেশ কয়েক মাস যাবার পর চাচা আসা বন্ধ করে দিল । মাঝেসাঝে আসত , তাও বেশীক্ষণ না থেকেই চলে যেত । তার নাকি শরীর ভাল থাকে না । চাচা না এলে ফুচকাতে যেন পেতাম না সেই স্বাদ । ফুচকা খাওয়ার ইচ্ছে , আনন্দ কমতে থাকল । চাচার ছেলেকে আমরা "ভাইয়া" বলতাম । ভইয়াও সেইসবই করত যা চাচা করত , তবুও যেন কিছু একটা কম লাগত । চাচার সেই স্নেহ ভরা "মুন্নী" ডাক , আদুরে গলায় খুনসুটি সবকিছুই চাচার শরীরের মত অসুস্থ হয়ে এল । ভাইয়ার কাছে রোজই চাচার খোঁজ করতাম , আর রোজ একই কথা বলত ভাইয়া যে ভাল নেই আরও অসুস্থ হয়ে পরছে । একদিন ভাইয়াও এল না । কি অদ্ভুতভাবে ফুচকার ঠেলাটা সেদিন দেখতে না পেয়ে কেমন একটা ভয় হয়েছিল , প্রথমবার হল ওরকম । কয়েকদিন পর ভাইয়া ফিরতেই ছুটে গেছিলাম তার না আসার কারণ জানতে আর সঙ্গে চাচার খোঁজ নিতে । চাচা নাকি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল । তারপর থেকে মাঝেমধ্যেই ঐ ফুচকার ঠেলাটা আসত না , যেন সেও তার মালিকের জন্য চিন্তিত । যতদিন ওখানে ছিলাম এইভাবেই দেখে গেলাম । তারপর বাবার ট্রান্সফার হয়ে গেল আর আমরাও নতুন জায়গায় চলে গেলাম । বন্ধুদের কাছে পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিলাম যে 'ফুচকাওয়ালা' নাকি চিরবিদায় নিয়েছে । বিশ্বাস হয়নি , আজও হয়না । মনে হয় যেন ভূল খবর শুনেছিলাম বা ওরা ভূল খবর পোয়েছিল । সেখানে গেলে হয়তো আজও "ফুচকাওয়ালা"কে ঐভাবেই ঠেলার ওপারে দাঁড়িয়ে থেকে ফুচকা বিক্রি করতে দেখব । সেও তার মুন্নীর জন্য অপেক্ষা করে আছে হয়তো ।

No comments:

Post a Comment