Sunday 29 January 2017

মেলা vs Fair



        শীতকালে চারিদিকে অনেক মেলা চলছে । তার মধ্যে ট্রেড ফেয়ার অন্যতম । আমার কাছে এ যেন অন্যই এক জগৎ । দেশী জিনিসপত্রের সাথে সাথে বিদেশী জিনিসেরও প্রচুর সম্ভার । অবশ্য আমরা মেলার শেষের দিকে গেছিলাম , আমরা যে দিন যাই তারপরের দিনই ছিল মেলার শেষ দিন । ততদিনে অনেক জিনিস নাকি কমে এসেছে । যদিও আমার একটুও তা মনে হল না । দেখে মনে হচ্ছিল যেন সবেমাত্র শুরু হয়েছে । কোথাও আড়ম্বড়ে একটুও খামতি নেই , জিনিসপত্রের কোনো অভাব নেই । প্রতিটা স্টলে ঠাসা জিনিস । সারি-সারি জামাকাপড় , তার ওপর চকচকে জড়ির কাজ করা । আর সেই সব চকচকে কাজের ওপর পড়ছে জোড়ালো আলো । কোথাও আছে চোখ ধাঁধানো রকমারি গয়না , বিভিন্ন রঙবেরঙের পাথর আর পুঁথির তৈরী গয়নাও তার মধ্যে বিশেষ আকর্ষণ । আবার কোথাও আছে শৌখীন জিনিসপত্র । আছে আসবাবপত্র , রোজকার কাজে ব্যবহৃত ছোট থেকে বড় জিনিস । মানে বলা যেতে পারে সমস্ত পৃথিবীর যাবতীয় সমস্ত কিছু ঐ এক জায়গতেই আমরা পেয়ে যাচ্ছি । বিদেশী জিনিস কিনতে আমাদের কাটতে হচ্ছে না প্লেনের টিকিট , বানাতে হচ্ছে না ভিসা । সব কিছুই হাতের কাছে চলে এসেছে । আর সেই সমস্ত জিনিসের দাম হল আকাশ ছোঁয়া । যদিও কোথাও কোথাও দর দাম করে সেই দাম একটু আধটু কমানো যাচ্ছে । যাই দেখি , তাই যেন পছন্দ হয়ে যায় । কিন্তু দাম শুনলেই ব্যস্ । তারই মধ্যে কি অসম্ভব ভীড় , কত লোক এসেছে , আর তারা কত কি কেনাকাটা করছে সবাই । সেরকম ভাবেই সমান তালে চলছে খাওয়া-দাওয়া । ওখানেই একটা বড় জায়গায় "ক্যাফেটেরিয়া" করেছে , একই ছাদের নিচে সব সুযোগ সুবিধে । কিছু লো টিস্যু পেপার দিয়ে যাচ্ছেন যারা খেতে বসেছেন পাত পেরে । আর সেখানেও আছে হরেক রকমের খাবার ... ভারতের সমস্ত জায়গার লোভনীয় আর সুস্বাদু খাবার আছে সেখানে । আছে হাত ধোয়ারও আলাদা ব্যবস্থা ।  তাছাড়াও আছে অন্যান্য সব সুবিধে , যেমন বিস্তর জায়গা জুড়ে বসার সুবিধে , শৌচালয় সুবিধে ।
        তাতেও এমন  কিছু নাক উঁচু মানুষজন দেখলাম , যারা ভীষণই অসন্তুষ্ট । চোখে মুখে বিরক্তি , সমস্ত জিনিস দেখেই নাক সিঁটকোচ্ছেন , এমন হাবভাব যেন ঐ সমস্ত মূল্যবান জিনিসও তাদের জন্য পর্যাপ্ত নয় । অথচ তাদেরই আবার দেখলাম যে কেনাকাটার কোনো কমতি নেই । প্রায় সমস্ত স্টল থেকেই কিছু না কিছু কিনে চলেছেন । ক্যাফেটেরিয়ার খাবার দেখে ভীষণভাবে নাক মুখ কুঁচকে বোঝাতে চাইলেন যে ঐসব খাবার তাদের স্টেটাসের সঙ্গে একদমই বেমানান । পরক্ষণেই আবার তা খেতেও ছাড়লেন না । শৌচালয়ও ব্যবহার করলেন তারা অনেক কিছু খুঁত বের করার পর । এত কিছু সুযোগ সুবিধের মধ্যেও তারা অসন্তুষ্টই থেকে গেলেন ।
        আমি মেলার সবকিছু দেখে বেশ আনন্দই পাচ্ছিলাম আর মুগ্ধ চোখে দেখে যাচ্ছিলাম । চোখের পলক ফেলতেও তখন আমার একটুও ইচ্ছে নেই । কারন , এতদিন আমার কাছে মেলার ছবিটাই ছিল সম্পূর্ণ আলাদা । ছোটো থেকে আমার কাছে মেলা বলতে ছিল বছরের দুটো মেলা , দুর্গাপূজার মেলা আর শীতের শেষের শিশুমেলা । পুজোর মেলাতে বিশেষ আকর্ষণ তখন মেলাতে বসা একখানা গয়নার দোকান , যেখানে থাকত গ্রামের মানুষের হাতের তৈরী কয়েকটা মালা আর দুল । হাতের চুরি পর্য্যন্ত সেই মেলায় পাওয়া যেত না । দোকানগুলোতে থাকত না কোনো জাঁকানো আলো । জ্বলত একটা টিমটিমে আলো , সেই আলোয় জিনিসপত্র ঠিকভাবে দেখাও যেত না । ওগুলোকে দোকান বললেও ভুল হবে , গুমটি বলাই ভাল । হাতে গোনা ৬-৭ টা ঐ রকম গুমটি । কেউ বাচ্চাদের জন্য প্লাস্টিকের খেলনা , কেউ গয়না , কেউ বিভিন্ন পোস্টার , কেউ বা মাটির তেরী খেলনা আবার কেউ বিভিন্ন ধরনের মূর্তি নিয়ে বসত । মেলা থাকত ঠিক চার দিন । সেই চারদিনের জন্য সারা বছর ধরে টাকা জমাতাম , আর ঐ চারদিনের মধ্যে সমস্ত জমানো টাকা শেষ হয়ে যেত । ক্লাব ঘরের সঙ্গে লাগোয়া পুজো মন্ডপ , সেই মন্ডপ ঘিরে তৈরী প্যাণ্ডেল । প্যাণ্ডেলের বাঁদিক করে ঐসব গুমটী আর ডানদিকে শুধু খাবারের দোকান .... মোগলাই পরোটা , ছোলে বটোরে , ঘুগনী , বিভিন্ন চপ আর মিষ্টি । অবশ্য বছর পেরোনোর সাথে সাথে আরো অনেক রকমের খাবারের ভ্যারাইটিজ যোগ হয় , ঢোসা, ইডলী , চাউ এইসব । কিন্তু এইসবের থেকেও বেশী দৃষ্টি আকর্ষন করত ক্লাব ঘরের ঠিক পাশেই একটা ঠেলাওয়ালা , ফুচকা নিয়ে । আমার জমিয়ে রাখা টাকা যেখানে শেষ হত , সেই "ফুচকাকাকুর" ঠেলা । স্কুল চলাকালীন স্কুলের সামনেও বসত সে । আমি মোটামোটি যাকে বলে তার "ডেইলী কাস্টোমার" । অনেক সময় যখন আমি স্কুল ফাঁকি দিতাম বা যখন সে একটু দেরী করে বাড়ী ফিরত, আমার বাড়ীর সামনে দিয়ে বেশ জোরে জোরে তার ঠেলার ঘন্টি বাজাতে বাজাতে । মনে পড়ে এখনও আমার তখন আমি থালা , বাটী আর গ্লাস হাতে ছুটতাম । আর বাইরে গিয়ে দেখতাম ফুচকাকাকু দাঁড়িয়ে আমার অপেক্ষা করছে , যেন সে আমার ছুটে যাওয়া টের পেয়েছে । ঠিক যেন "কাবুলীওয়ালা" গল্পের মত "ফুচকাওয়ালা"ও তার "মুন্নী"রূপী "খোঁকি"র অপেক্ষা করছে । মেলাতেও সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত । টাকা দিয় খাওয়া ছাড়াও সেখানে উপরী পাওনাটা বেশী হয়ে যেত , বিনা দামে বেশ কতকগুলো ফুচকা , তার তেঁতুলের থলি থেকে তেঁতুল , কখনও এমনিই কখনও বা তা লঙ্কা নুন দিয়ে মাখানো । কত আন্তরিকতা তার মধ্যে , কত স্নেহ জড়ানো রয়েছে তাতে । এখনও মনে পড়লে গলার কাছটা কেমন যেন ব্যথা হয় , চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে । বাকি খাবারের দোকানের দাদা-কাকুরও ছিল প্রায় চেনা পরিচিতি । যেখানেই যেতাম আমরা বন্ধুরা দল মিলে , সবাই বেশ সস্নেহে আপ্যায়ন করত ।
        আর এক মেলা হল শিশুমেলা । সেটা অবশ্য বেশ খানিকটা দূরে হত । সেখানে যেতে হলে একা বা বন্ধুদের সাথে যাওয়ার কোনো উপায় নেই । বড়দের ছাড়া সেখানে যাওয়া আমাদের এলাকার বাচ্চাগুলোর পক্ষে সম্ভব ছিল না । তাই বড় ছোট সবাই মিলে হইহুল্লোর করে আমরা সেখানে যেতাম । দেখে মনে হত যেন পিকনিকে যাওয়া হচ্ছে । আর সেই মেলার বিশেষ আকর্ষণ ছিল নাগরদোলনা আর হেলিকপ্টার , যেগুলোয় বসার জন্য আমরা মরিয়া হয়ে উঠতাম । এখনও মনে পড়ে সেই দিনগুলো .... বাবার হাত ধরে হেলিকপ্টারে চাপা আর নামবার সময় এত মাথা ঘুরত যে আমাকে বাবা কোলে করে নিয়ে নামত ।  নাগরদোলনায় একেবারে পাঁচবারের টিকিট কেটে উঠতাম , সেখানে অবশ্য বন্ধুদের সাথে । যখন ওপর থেকে নিচের দিকে দোলনাটা নামত , পেটের ভিতর কেমন যেন কাতাকুতুর মত হত । তবুও দোলনার কাকুকে আরও জোরে ঘোরাতে বলতাম আর কাকু হাসিমুখে একটু বাড়িয়েই আবার কখন কমিয়ে দিত যাতে আমাদের অসুবিধে না হয় আর আমরা তা বুঝতেও পারতাম না । আর মা নীচে থেকে মা ভয়মাখা চোখে পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে আর আমি দোলনা থেকে মাকে আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করতাম । কিন্তু দোলনা থেকে না নামা পর্য্যন্ত মায়ের শান্তি হত না । তারপরই হইহই করে খাবারের দোকানে হামলা । সেখানেও ঐ একই দুর্গাপূজোর মেনু , আর একটু বেশী বলতে চাউমিন , এগরোল , চিকেন রোল । তখন তো টিস্যু পেপার দেওয়ার লোক তো দুরের কথা , টিস্যু পেপারই কেউ চিনতাম না । তাই খাওয়া হলে ওদের খোলা জলের ড্রাম থেকেই জল বের করে হাত মুখ ধুয়ে রুমালে মুছে নিতে হত । খাওয়া সেরে চুরি , মালা , ফিতে , আরও ঐরকম টুকটাক জিনিস কিনেই বাড়ির পথ ধরতে হত । কারণ , শৌচালয়ের পরিষ্কার কোনও ব্যবস্থা ছিল না ।
ঐসব মেলাতে ছিল না এত জাঁকজমক , ছিল না এত আড়ম্বর , ছিল না এত রকমারি জিনিস , এত চোখ ধাঁধানো ব্যাপার , এত সংগঠিতভাবে সাজানো .... কিন্তু ছিল সবাইকে খুশি করার সামর্থ্য , অল্পেতে সন্তুষ্ট হওয়ার অভ্যেস , খুব সহজেই কাউকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা । সেই সব মেলায় হত মিলন , তৈরী হত নতুন সম্পর্ক , পুরনো সম্পর্ক হয়ে উঠত আরও দৃড় । এই ট্রেড ফেয়ার তার নামকে সার্থক করে , কিন্তু মেলা নয় । a trade but it's not fair . এখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক হয় কেবলমাত্র টাকার বিনিময়ে , ক্রেতা আর বিক্রেতা , সেখানে দু'পক্ষ থেকেই আন্তরিকতা বলে কিছু থাকে না । অবশ্য এখন এইরকম না হলে চলেও না হয়ত । অত চাকচিক্যপুর্ণ মেলা ঘুরে খুব ভাল লাগার কথা ছিল আমার , কিন্তু ঠিক হতে পারলাম না । মেলা vs fair এর পার্থক্যটা যেন প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছিলাম ।

No comments:

Post a Comment