Tuesday 2 May 2017

বিয়ের বেনারসি

কম্পিউটার স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে অলি এক মনে রিপোর্ট তৈরী করছিল । কাজটা শেষ হলেই বেরিয়ে পড়বে অফিস থেকে, তাই ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে সেও ছুটে চলেছে । আজকের ছুটি নিয়ে আগে থেকেই বসকে জানানো ছিল, কিন্তু ক্লাইন্ট রিপোর্টটার জন্য তাঁকে আসতেই হল অফিসে । সে আর শান্তনু মিলে আজ মুভি আর ডিনারের প্ল্যান করেছে । তার আগে অবশ্য আছে বিয়ের কেনাকাটা । আর দু'মাস পরেই যে ওদের বিয়ে । অথচ এখনও তার কিছুই কেনা হয়নি ।
অলকা মজুমদার আর শান্তনু দে, দুজনেই মা-বাবার একমাত্র সন্তান । বরানগরের গঙ্গাঘাটের কাছে, পাশাপাশি পাড়ায় দুজনের বাড়ি । স্কুলজীবন থেকেই তারা একসাথে থেকেছে, একই কলেজে পড়েছে । চাকরীও করে তারা, যদিও দুজনের কোম্পানি আলাদা । ব্যস্ত জীবনের মধ্যেও তারা নিজেদের জন্য সময় বের করে অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে গঙ্গাঘাটে কয়েক মিনিটের জন্য দেখা করে রোজ । শনি-রবি করে কোনো একজনের বাড়িতে দুপুরের লাঞ্চ হয় একসাথে । কিন্তু সামনে বিয়ের অনেক কাজ, এই দু'মাস আর সেভাবে সময় পাবে না তারা । আজ তাই এই প্ল্যানটা করেছে, দুজনে একসাথে একটু বেশী সময় কাটাতে পারবে বলে । ভাবতে-ভাবতেই একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল অলি । অফিসের ঘড়িতে বারোটার ঘণ্টা বেজে উঠতেই আবার কাজে মন দিল । কাজ শেষ হতে বাজল ১:৪৫ । বসের কেবিনে রিপোর্টটা পাঠিয়ে দিয়ে সে বেরোনোর জন্য সব গুছিয়ে তার হ্যান্ডব্যাগে পুরতে লাগল । ফোন চেক করতে গিয়ে দেখল শান্তনুর তেইসটা মিসড কল । এমনিতে অফিসে তার ফোন ভাইব্রেট মোডেই থাকে, কিন্তু আজ কাজ শেষ করার তাড়ায় সেটা সাইলেন্ট রেখেছিল ।
"সন্টাই নিশ্চয় অনেকক্ষণ এসে অপেক্ষা করছে (অলি ভালোবেসে শান্তনুকে সন্টাই বলে), তাই হয়তো এতবার ফোন করেছে । আজ তো সেও নিজের অফিস ছুটি নিয়েছে" ভাবতে-ভাবতে সে শান্তনুকে ফোন করে, "আর দু মিনিট একটু কষ্ট করে অপেক্ষা কর বাবু, আমি এক্ষুনি বেরোচ্ছি । তুই টিকিট কেটে নিয়েছিস তো?"
শান্তনু গম্ভীর গলায় একটু তাড়া দিয়ে বলল, "আগে তুই আয় গুডলুই (শান্তনু ভালোবেসে অলিকে 'গুডলুই' বলে), জরুরী কথা আছে ।"
শান্তনুর গলা শুনে অলি কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় । সময়নষ্ট না করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে অফিস থেকে ।
মেইন গেটের সামনে শান্তনুকে আনমনা অবস্থায় দেখতে পেয়ে অলি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,"কিরে সন্টাই, অফিস ছুটি চাওয়া নিয়ে কি বস ঝামেলা করেছে?" অলি জানে যে শান্তনুদের বস খুব বদমেজাজি, সবসময় ঝামেলা করে । তাই প্রশ্নটা করল ।
"অফিসে কিছু হয়নি রে গুডলুই, ওখানে সব ঠিক আছে ।" বলতে বলতেই শান্তনুর গলাটা কেমন শুকিয়ে এল । অলি শান্তনুকে জলের বোতল দিয়ে অফিসের পাশের ক্যাফেটেরিয়াটা দেখিয়ে বলল, "চল, ওখানটায় বসে আগে কথা বলেনি ।"
ক্যাফেটেরিয়াতে গিয়ে শান্তনু অলিকে বলল, "তোর চাঁদজেঠুর কথা মনে আছে?"
"তা আবার থাকবে না? কিন্তু এরকম কেন জিজ্ঞেস করলি?", অবাক হয়ে অলি জিজ্ঞেস করে ।
শান্তনু বলল, "আজ সকালে জেঠুর হার্ট অ্যাটাক হয়েছে শুনলাম, নার্সিংহোমে ভর্তি আছেন । মজুমদার কাকু দেখছেন, সবাই ওখানেই আছে । তুই চিন্তা করবি বলে তোকে কিছু জানাতে চায়নি" ।
"কি বলছিস তুই?" চমকে উঠল অলি । শান্তনু বলে চলেছে, অলি দেখতে পাচ্ছে যে ওর ঠোঁটদুটো নড়ছে । কিন্তু সে আর কিছুই শুনতে পাচ্ছে না । কি করে শুনবে, সে যে এখন এই বাস্তব সময় পেরিয়ে চলে গেছে অতীতের সময়ে । এই চাঁদজেঠুকে নিয়ে কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার জীবনে ।
অলির ছোটোবেলার অনেকটা সময়ই ছিল এই মানুষটাকে জড়িয়ে । অলিদের পাড়াতেই ভাড়ায় থাকতেন মানিকচাঁদ গড়াই, বউ আর তিন ছেলে নিয়ে । অলির কাছে তিনি ছিলেন তার প্রাণের চাঁদজেঠু । অলিও ছিল মানিকবাবুর চোখের নয়নমণি । দু'বেলা অলিকে ভালভাবে না দেখতে পেলে রাতে ঘুম হত না তাঁর । অফিস থেকে ফিরেই মানিকবাবু ব্যাগ রেখে অলিকে কোলে করে সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়ে পড়তেন । আর সঙ্গে হত সারাদিনের জমানো খুঁটিনাটি কথা, ঘন্টার পর ঘন্টা চলত সেই গল্প । অলির মুখের দিকে তাকালে মানিকবাবু তাঁর সারাদিনের ক্লান্তি ভুলে যেতেন ।
অলিকে মা বলতেনবলতেন, তখন নাকি তার সবে কথা ফুটেছে, আধো-আধো কথা । সেই কথাই খুব মনযোগ দিয়ে শুনতেন তার চাঁদজেঠু । আবার মাঝে মাঝে অলির কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মাথা নাড়তেন, হাসতেন, উত্তর দিতেন । অলি আর মানিকবাবুর সেই কথোপকথন শুনে কেউ যদি কখনও জিজ্ঞেস করতেন, "ও কি বলল আপনি বুঝতে পেরেছেন মানিকবাবু?" মানিকবাবুও হেসে উত্তর দিতেন, "তাই কি আর না বুঝি, এটা যে আমাদের 'চাঁদালি ভাষা' গো, চাঁদ আর অলির ভাষা । আর কেউ যাতে আমাদের গোপন কথা বুঝতে না পারে তার জন্যেই তো আমার রানীমা এই ভাষার আবিষ্কার করেছে" । অলিকে ভালবেসে 'রানীমা' বলে ডাকতেন মানিকবাবু । অলির মনে পড়ে, সে অসুস্থ হয়ে পড়লে তার চাঁদজেঠু কেমন দিশেহারা হয়ে যেতেন । সকাল-বিকেল এসে অলিকে দেখে যেতেন, ঘুম উড়ে যেত তাঁর । আবার অলির স্কুলে যাওয়া নিয়ে কেমন আনন্দে মেতে উঠেছিলেন তিনি । স্কুলের জুতো, ব্যাগ, জলের বোতল, ছাতা, পেন্সিল বক্স .... এমনকি ইউনিফর্মও তিনি নিয়ে এসেছিলেন ।
অলির বাবা, রণজিৎ মজুমদার, পেশায় ডাক্তার । বেশীরভাগ সময়ই ব্যস্ত থাকতেন রুগী আর নার্সিংহোম নিয়ে । তাই অলির স্কুলের দায়িত্বটা মানিকবাবুর ঘাড়ে গিয়েই পড়েছিল । যদিও 'পড়েছিল' বললে ভুল হবে । তিনি নিজে থেকে যেচেই সেই দায়িত্ব নিয়েছিলেন । সেই সবদিনের কথা আজও মনে পড়লে অলির ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক পড়ে । গাড়ি থাকা সত্ত্বেও মানিকবাবু তাকে কাঁধে বসিয়ে স্কুলে নিয়ে যেতেন, এক হাতে ব্যাগ আর অন্য হাতে জলের বোতল । আর কাঁধে বসাতেন তাঁর রানীমাকে । অলি কাঁধে বসে ছাতা মাথায় রানীর মত যেত আর মানিকবাবু তখন তাঁর রানীমা-র সওয়ারী হতেন । অলিকে স্কুলে ছেড়ে আসতে চোখ ছলছল করত মানিকবাবুর । স্কুলছুটির পর অলি যখন ছুটে যেত তার চাঁদজেঠুর কাছে, তখন মানিকবাবুও এমনভাবে জড়িয়ে ধরতেন যেন কত বছর দেখতে পাননি তাঁর রানীমাকে ।
জেঠুর সেই আরামকেদারাটার কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল অলির । হাল্কা সবুজ রঙের, জেঠুর খুব প্রিয় ছিল । কাউকে সেটায় হাত পর্যন্ত দিতে দিতেন না । অথচ তাঁর রানীমার ছিল তাতে অবাধ স্বাধীনতা । অলি সবসময় ওটাতেই বসতে পছন্দ করত । নিজেরই দোষে অলি সেবার পড়ে গিয়েছিল আরামকেদারা থেকে । কিন্তু তার চাঁদজেঠু দোষ দিয়েছিলেন নিজের প্রিয় আরামকেদারাটাকে, বসাই ছেড়ে দিয়েছিলেন তাতে । এমনকি সেটাকে বেচেও দিয়েছিলেন শেষে । নিয়ে এসেছিলেন তাঁর রানীমার জন্য নতুন আরামকেদারা । ওতে অবশ্য নিজে কোনোদিন বসেননি । বা হয়তো এটাকে নিজের প্রিয় আরামকেদারার জায়গাটা কোনওদিন দিতে পারেননি ।
 "সেদিন বুঝিনি, আজ মনে পড়ে সেদিন জেঠুর সেই জলভরা চোখ । খুব কষ্ট হয়েছিল জেঠুর নিজের প্রিয় জিনিসটাকে অন্য কাউকে দিয়ে দিতে", সেই দিনটার কথা ভেবে অলির নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় । "আমি যদি সবসময় ঐ আরামকেদারায় বসায় বায়না না করতাম তাহলেই জেঠুকে ওটা নিজের থেকে আলাদা করতে হত না", অলির যেন গলা ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছে ।
একদিন চাঁদজেঠু পরিবার নিয়ে চলে গেলেন নিজেদের দেশের বাড়ী, বর্ধমানে । প্রথমদিকে প্রায় আসতেন তিনি, তাঁর রানীমাকে দেখতে । সঙ্গে নিয়ে আসতেন অলির জেঠীমার হাতে তৈরী মুড়িভাজা, ছোলাভাজা আর মশালা চিঁড়েভাজা । এগুলো অলির ভীষণ প্রিয় ছিল । কিন্তু ধীরে-ধীরে তার চাঁদজেঠুর আসা কমতে থাকে । কিছুটা বয়স বেড়ে যাওয়াতে, কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ার জন্য । কিন্তু হাজার শরীর খারাপ আর কাজের মধ্যেও অলির স্কুলের প্রোগ্রাম কখনও মিস করতেন না তিনি । অলির মনে পড়ল সেই বছরের কথা যে বছর তাঁর চাঁদজেঠু শেষবার এসেছিলেন অলির প্রোগ্রাম দেখতে । সেদিনের কথা মনে পড়লেই লজ্জায় অলির চোখের পাতা ভারী হয়ে আসে, "ছিঃ, কতটা নিচু মানসিকতা হলে মানুষ এরকম করতে পারে ।" প্রতি বছর প্রোগ্রাম শেষে চাঁদজেঠু অলিকে সঙ্গে করে বাড়ী নিয়ে আসতেন । বাড়িতে সবাই একসাথে খাওয়া-আড্ডা দিয়ে চাঁদজেঠু আবার ফিরে যেতেন তাঁর বাড়ীতে । কিন্তু সে বছর যেন সময় ঠিকই করে রেখেছিল সব কিছু নষ্ট করে দেওয়ার । সে বছর অলির প্রোগ্রাম দেখে তার সঙ্গে দেখা না করেই মানিকবাবু ফিরে যেতে চেয়েছিলেন নিজের বাড়ীতে । অলির বাবা তাঁকে জোর করে বাড়ী নিয়ে এসেছিলেন । অলি এই ব্যাপারটা নিয়ে অভিমান করে চাঁদজেঠুর সাথে প্রথমে কথা বন্ধ করে দিয়েছিল । কিন্তু বারবার করে অলির মা-বাবা যখন বললেন, "যাও অলি, তোমার চাঁদজেঠুর সাথে কথা বল । এত শরীর খারাপ নিয়েও তোমার প্রোগ্রাম দেখতে এসেছেন তিনি । ওভাবে রেগে থাকলে ভালো দেখায় না, জেঠু কষ্ট পাবেন", তখন জেঠুর দিকে এগোতে গিয়েও ছিটকে এসেছিল সে । এতক্ষণ সে খেয়ালই করেনি, জেঠুর শরীরের ক্ষতগুলো । যে টুকু অংশ বেরিয়ে আছে, দেখা যাচ্ছে গলা-পচা ঘা । অলির ভীষণ ঘেন্না হয়েছিল জেঠুর ঐ ঘায়ে দগ্ধ শরীর দেখে । জেঠু হয়ত আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন এরকম পরিস্থিতি হবে । তাই তো প্রোগ্রাম দেখেই ফিরে যেতে চেয়েছিলেন । অলির বাবা মানিকবাবুর ঘাগুলো দেখে ওষুধ লিখে দিচ্ছিলেন । বাবাকে ওভাবে জেঠুর গায়ে হাত দিতে দেখে অলির খুব অসুবিধে হচ্ছিল । আড়ালে সে বাবাকে বলেছিল, "তুমি আর জেঠুকে ছোঁবে না .... ইস, কি নোংরা হয়ে আছে জেঠুর শরীরটা" । হয়তো জেঠু শুনতে পেয়েছিলেন সে কথা । তাইতো মা-বাবার অনেক বলা সত্ত্বেও লজ্জায় সেদিন দুপুরের খাবার না খেয়েই তিনি চলে গিয়েছিলেন । বাবা-মা সেদিন খুব বকেছিলেন অলিকে । সেদিন অলি ভুলে গিয়েছিল, তার হামের সময় এই চাঁদজেঠু কিন্তু তাকে কখনো দূরে সরিয়ে দেননি । দরকারে অ-দরকারে সবসময় অলির সঙ্গে থেকেছেন । লজ্জা আর গ্লানিবোধে অলির দমবন্ধ হয়ে আসছিল । সেইদিনের পর তার চাঁদজেঠু আর কোনওদিন আসেনি তার সামনে । অলি বাবার কাছে শুনেছিল যে চাঁদজেঠু তার বাবার কাছে আসতেন চিকিৎসার জন্য । কিন্তু অলি কোনোদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যেত না । মানিকবাবুও নিজের ওই ক্ষত শরীর আর তার থেকেও বেশী ক্ষত মন নিয়ে অলির সামনে যেতেন না ।
"শরীরের ক্ষতগুলো হয়তো কোনওদিন সেরে যাবে । কিন্তু মনের যে ক্ষতটা আমি দিয়েছি সেটা কি আর সারবে কখনও?", এই ভেবে চোখের জল মুছে অলি শান্তনুকে বলল, "আমাকে ওখানে নিয়ে যেতে পারবি সন্টাই?"
শান্তনু কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই অলি আবার বলে উঠল, "এক্ষুনি যেতে চাই । নিয়ে যাবি?"
সময়নষ্ট না করে দুজনে মিলে চলল চাঁদজেঠুর কাছে । নিজের অপরাধটা বোঝার পর অলি অনেকবারই ভেবেছিল জেঠুর কাছে ক্ষমা চাইবে । হোক তার জেঠুর শরীর ঘায়ে দগ্ধ, হোক তা ঘেন্নাময় । তাতে অলির আর কিছু এসে যায় না । তাঁকে ফিরিয়ে আনবে নিজের জীবনে, আবার আগের মত করে ।
অলির বাবার চিকিৎসাধীনেই রয়েছেন তাঁর চাঁদজেঠু । সেখানে গিয়ে সে জড়িয়ে ধরল তার চাঁদজেঠুকে ।
"তোমার প্রতি আমি খুব অন্যায় করেছি চাঁদজেঠু, আমায় ক্ষমা করে দাও । যা শাস্তি দেবে মাথা পেতে নেব, কিন্তু আবার আগের মত আমার জীবনে ফিরে এস । পারবে না নিজের রানীমাকে একটা সুযোগ দিতে?", কাঁদতে কাঁদতে অলি বলল ।
অলির মাথায় হাত রেখে একটু হেসে মানিকবাবু বললেন, "যা শাস্তি দেব, মাথা পেতে নেবে তো?" ।
"হ্যাঁ, তুমি যা বলবে চাঁদজেঠু", কাঁপাস্বরে অলি বলল ।
মানিকবাবু তখন অলিকে একটা প্যাকেট ধরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, "দেখ তো রানীমা, এটা তোমার পছন্দ হয়েছে কি না?" ।
অলি প্যাকেট খুলে দেখে তাতে একটা শাড়ী । অবাক হয়ে সে মানিকবাবুর দিকে তাকিয়ে দেখল যে তার চাঁদজেঠুর মুখে এক শান্ত, স্নিগ্ধ হাসির ছটা ।
"তোর চাঁদজেঠু কি কখনও তোর ওপর রেগে থাকতে পারে? বিয়ের খবর পেয়েই কেনাকাটা শুরু করে দিয়েছেন । এটা বেনারসি । আরও অনেক কিছু আছে", পাশ থেকে অলির মা বললেন ।
মায়ের কথা শুনে অলি আর কিছু বলতে পারে না । তার সব কথা যেন গলার কাছে এসে দলা পাকিয়ে আটকে যাচ্ছে, চোখ দিয়ে অঝোরে ঝরে পড়ছে অশ্রুধারা । ঝাপসা চোখে শাড়ীটাকে দেখে, সে তার চাঁদজেঠুর বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরে বলল, "আমার বিয়ের বেনারসিটা খুব সুন্দর হয়েছে চাঁদজেঠু" ।

Saturday 25 February 2017

আমার প্রিয় বন্ধু

আমাদের সবারই জীবনে এক বা একাধিক প্রিয় বন্ধু থাকেই । যদিও আজকাল সে রকম অর্থে প্রকৃত বন্ধু খুঁজে পাওয়া একটু অসম্ভব হয়ে গেছে । সেটা অবশ্য আমার লেখার বিষয়বস্তু নয় । আমি এখানে বলতে চাই আমার এক প্রিয় বন্ধুর ব্যাপারে , সঙ্গীতা । আমাদের আলাপ হয় এক গার্লস্ স্কুলে । আমার জীবনের প্রথম আর শেষ গার্লস্ স্কুল । তাই অনেকটাই বাঁধনছাড়া গরুর মত অবস্থা হয়েছিল আমার । তার ওপর সঙ্গীতাকে পেয়ে আরও মেতে উঠেছিলাম । ওর মত মেয়ে আমি আমার জীবনে দেখিনি বললেই চলে । এত আনন্দ আর হইহুল্লোর করত যে পুরো ক্লাসকে মাতিয়ে রাখত । ওর সঙ্গে স্কুল জীবনে আমি এমন অনেক কাজ করেছি যেগুলো ওকে পাওয়ার আগে আমি কোনোদিন করব বলে কল্পনাতেও ভাবিনি । ওর সঙ্গে বসে , স্কুলের সব থেকে রাগী টিচারের ক্লাসে বসে পেয়ারা আর কুল খাওয়া আজও মনে পড়ে যায় । গন্ধে পুরো ক্লাস ভরে যেত , কি ভয়টাই না হত । এই বুঝি ধরা পড়ে যাব ভেবে । একবার প্রায় ধরাও পড়তে যাচ্ছিলাম । সে যাত্রা সেই বাঁচিয়েছিল নিজের ওপর দোষ নিয়ে । যদিও বকুনিটা ঐ বেঞ্চের সবার কপালেই জুটেছিল । বেঞ্চে দাঁড়িয়ে ষাঁড় চিৎকার করে গান গাওয়া আর সঙ্গে উন্মাদ নৃত্য । স্কুলের বড়দিদিমণিকে প্রায় দিনই আসতে হত আমাদের ক্লাসে , বকুনি আর সাবধানবার্তা দিতে । ক্লাস মনিটরের কাছেও কম ধমকি খেতাম না । কিন্তু বাগে আর আনতে পারত না কেউই । আমাদের ক্লাসরুমের বাইরের দিকে তখন কোনও দেওয়াল বা বেড়া দিয়ে ঘেরা ছিল না , মানে জানলার বাইরেই কয়েকহাত পর রাস্তা ।  সেই জানলা দিয়ে সঙ্গীতা আর আমার আর সঙ্গে আরও কয়েকজনের চলত নিয়মিত আদান-প্রদান .... আইস্ক্রীম , বরফ , ঝালমুড়ি কেনা , থাকত তেঁতুল মাখাও । তার এইরকম পাগলামি চলত টিউশন ক্লাসেও । আমি সেখানেও বেশ সঙ্গ দিতাম । পড়তে-পড়তে হঠাৎ পিছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে রাস্তার ধারের খেজুর গাছ থেকে খেজুর পাড়া  বা সেই টিউশন স্যারেরই উঠোনের আম গাছ থেকে আম পাড়া । সব নিয়ে এসে এক জায়গায় এনে রাখত সে । একা কখনই সে ঐসব খেত না , সবার মধ্যে ভাগ করে খেতেই পছন্দ করত । এমনকি স্যারকেও দেওয়া হত । তাই রাগ না কমিয়ে আর উপায়ও থাকত না স্যারের । দিনের বেশীরভাগ সময়টাই আমরা একসাথে থাকতাম । সারাদিন অগুন্তি কথা চলত আমাদের । অত কথার মধ্যে যদি ভুল করেও কোনও কথা বাদ চলে যেত তাহলে সেই রাতটা যেন আরও লম্বা হয়ে যেত কাটাতে । কিন্তু সময়ের সাথে সব পাল্টাতে থাকল । আমরা একসাথে একই জায়গা থেকে পড়াশোনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েও শেষ পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি । যোগাযোগ বলতে লম্বা ছুটির সময় বাড়ি গেলে আমাদের কয়েকঘন্টার দেখা । সেই সময় এতই কম হত যে সব কথা বলাও হত না । অনেক কথা না-বলা হয়েই থেকে যেত । তারপর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংগুলোর কৃপায় আমাদের যোগাযোগের মাধ্যমটা আর একটু বাড়ল । কিন্তু কিলোমিটারে দুরত্ব বাড়ার যে একটা প্রভাব থাকে , সেটা বুঝতে পারি যখন সেই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটেই এক অজানা ছেলের কাছ থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট আসে এই বলে যে সে নাকি এখন সঙ্গীতার জীবনের স্পেশ্যাল মানুষ হয়ে উঠেছে । সারাদিন তখন আমাদের বেশ ভালই কথা হত , এত ভাল বন্ধু আমরা যে দুরে থেকেও একে অপরকে সব বলতাম । অথচ সেদিন অন্য লোকের থেকে তার ব্যাপারে এত ভাল একটা খবর জানতে হয়েছিল বলে বেশ একটু রেগেই গিয়েছিলাম । মান অভিমানের পালাও চলেছিল বেশ কয়েকদিন । তারপর অবশ্য আবার সব আগের মত হয়ে গিয়েছিল । মাঝেমধ্যে আমরা তিনজনেই বেশ আড্ডা দিতাম ফোনে বা সাইটে । ওদিকে থাকত ওরা দুজন , আর এদিকে আমি । ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যেত আড্ডায় । পরীক্ষার জন্য মাঝেমধ্যেই একটু বেশীই গ্যাপ পরে যেত আমাদের । ওর জন্মদিন ছিল , শুভেচ্ছা জানানোর জন্য তাই ফোন করলাম ,  ওপার থেকে একটা মেয়ের গলা । কিন্তু সে যে আমার সঙ্গীতার গলা নয় । কে সে ? কেনই বা সঙ্গীতার ফোন ধরে সঙ্গীতাকে ডেকে দিতে বললেও দিচ্ছে না । কি বিচ্ছিরি একটা হাসি হেসে বলল যে সে কোনো সঙ্গীতাকে চেনে না । সোশ্যাল সাইটে সঙ্গীতাকে যোগাযোগ করতে গিয়ে দেখি তার প্রোফাইলটাও নেই । আবার সঙ্গীতার সাথে যোগাযোগ কেটে গেল । সেই তিনমাসে কি হয়েছিল তা আজও জানিনা , কোনোদিন জানার চেষ্টাও করিনি । ভেবেই নিয়েছিলাম যে সেটা তার খুব পার্সনাল ব্যাপার । কিন্তু যোগাযোগ করার চেষ্টা খুব করেছিলাম , নিজের রাগটা ঝারব বলে । তাই তার স্পেশ্যাল মানুষটিকে মেইল করে ওর ব্যাপারে খোঁজ নিতে বাধ্য হয়েছিলাম । শুনলাম তার সঙ্গেও নাকি যোগাযোগ নেই আর । কিছুটা ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম । ছুটিতে বাড়ি গিয়েই তাই ছুটেছিলাম ওর বাড়িতে । কাকিমার কাছে একটা নম্বরও পেয়েছিলাম , আর একটু স্বস্তিও । কিন্তু ওটাতেও শুধু তখনই কথা বলা গেল । কাকিমার সামনে বেশী কিছুই বলতে পারিনি তখন । সে বলেছিল দেখা হলে নাকি অনেক কিছু বলবে । তারপর অনেক চেষ্টা করেও আর যোগাযোগ করতে পারিনি সেই নম্বরে । ভেবে নিয়েছিলাম যে ও হয়তো আমাকে আর প্রিয় বন্ধু হিসেবে দেখে না । সময়ের সাথে তো অনেক কিছুই পরিবর্তন হতে থাকে , এটাও একরকম তাই । ততদিনে আমার বাবার ট্রান্সফার হয়ে যায় । আর আমরা ঐ জায়গা ছেড়ে চলে আসি । সব ভুলে যাই সময়ের সাথে । আমার জন্মদিন । সকালে উঠেই মনে পড়ে গেল সঙ্গীতার কথা । পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকত না কেন , এই দিনটায় ও আমাকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানাতই । কিছুক্ষন পরেই ফোন আসে এক অজানা নম্বর থেকে , পুরুষকন্ঠ । পাশ থেকে একটা মেয়ের গলায় কেউ হাসছে খুব , চেনা হাসি । পুরুষকন্ঠে যিনি কথা বলে যাচ্ছিলেন তাঁর কোনো কথাই আমি মন দিয়ে তখন শুনছিলাম না । তাঁর কথা থামিয়ই বলে উঠেছিলাম "পাশে সঙ্গীতা হাসছে না?" । ফোনটা এবার তিনি পাশের মেয়েটিকে দিয়ে দিলেন । ওপাশ থেকে হাসি থামিয়ে মেয়েটি বলল , "হ্যালো" । সঙ্গীতা । প্রচন্ড রাগ হল আমার আর গলার কাছে যেন সব কথা আটকে গেল । কিছুক্ষন পর ধাতস্থ হয়েই আমি আমার নালিশের সিন্দুক খুলে বসে পড়লাম । সেও যে খুব দুঃখ প্রকাশ করল । বলল যে সে নাকি বিয়ে করেছে । ঐ পুরুষকন্ঠের ব্যক্তিই নাকি তার স্বামী । ভীষণ খুশি হয়ছিলাম , আবার রাগও হয়েছিল খুব । বিয়ে করে নিল আর আমার নম্বর জানা সত্ত্বেও আমাকে একবার জানাল না ?!! যাই হোক , আমাদের আবার যোগাযোগ তো হল । আর সে নতুন জীবনে পা রেখেছে । এই ভেবে আর বেশী কিছু বলতেও পারলাম না । কিন্তু সম্পর্কে একবার ভাঙন ধরলে যে তা আর আগের মত হওয়ার নয় । আমার বিয়ের সময় আবার আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় । আর এইবার আমি যে খুব একটা চেষ্টা করেছিলাম যোগাযোগের তাও নয় । মনে হয়েছিল সেও তো আমাকে না জানিয়ে বিয়ে করেছে , আমি করলেই বা দোষ কি ? আমার সেই ভাবনায় মন খারাপ হয়েছিল কি না জানি না , বা হয়ে থাকলেও যে খুব হয়েছিল তা মনে হয় নয় , কিন্তু রাগটা বেশ খানিকটা কমে গিয়েছিল । বিয়ে করে শশুরবাড়ি আসার পর অবশ্য স্কুলের কিছু বন্ধুদের দৌলতে আবারও আমাদের যোগাযোগ হয় । এবার অবশ্য ঝগড়া নয় , কেমন যেন দুরত্ব চলে এসেছিল আমাদের মধ্যে । চেষ্টা করেও তা কমানো যায়নি । না বললে নিজেকেই অপরাধী মনে হবে .... এবার দুরত্বটা ছিল কিছুটা আমার দিক থেকেই । সঙ্গীতা চেষ্টা করেছিল সবটা আগের মত করে নেওয়ার । এইবার আমি আর নিজের ব্যাপারের সব কথা চেষ্টা করেও বলতে পারতাম না ওকে । তার ওপর মাঝেমাঝেই আমি একটু বকাবকি করে ফেলতাম । বেচারী সবই চুপ করে মেনে নিত । আমাদের মাঝেমধ্যে কথা হত । আমার বাড়িও আসবে বলেছিল । বলেছিল যে সামনে বসে আমার বকুনি শুনবে । আর আমদের সম্পর্কটা আবার আগের মত করে দেবে । কিন্তু সে সময় আর এল না । একদিন এক বন্ধুর ফোন এল .... সে বলল যে সঙ্গীতা আর নেই । আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম । দু'দিন আগেই সে আবারও বকা খেয়েছিল । নেই মানে? আবার না বলে পালাল সে? এবার সে অনেক দুরে পালিয়ে গেল যে !!! কয়েকদিন ধরে তার নাকি খুব শরীর খারাপ ছিল । সেটাও সে বলেনি কাউকে । আর তাঁকে কোনোদিন খুঁজেও পাব না । এভাবে আবার ছেড়ে যাওয়ার জন্য আর ঝগড়াও করতে পারব না । আমার রাগ , ঝগড়া , অভিমান , বকুনি সবকিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সে আজ অনেক দুরে । ওখানে তো কোনও সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট পৌঁছোয় না । আর কোনোদিন তাঁকে খুঁজে পাব না । আমার জন্মদিনে আর তাঁর ফোনও আসবে না । এখনও মনে হয় সে হয়ত আবার কয়েকদিন পর ফিরে আসবে ।
আমি আগেও চাইতাম , এখনও চাই .... তুই যেখানেই থাকিস , ভাল থাকিস । 

Saturday 11 February 2017

মুন্নী ও ফুচকাওয়ালা

ছোটোবোলায় অনেকে "কাবুলীওয়ালা"-র গল্পটা শুনেছে , পড়েছে বা সিনেমাতে দেখেও থাকতে পারে । আমি যেমন সিনেমাতে দেখেছিলাম । তখন খুউব ছোটো আমি । সিনেমা দেখার অদ্ভুত নেশা ছিল । যদিও হল-এ গিয়ে কোনোদিন সিনেমা দেখার সুযোগ হয়নি । কি করেই বা দেখব , সেখানে তো কোনও হলই ছিল না । তাই সবকিছু টেলিভিশনেই দেখতাম । ওতেই দেখেছিলাম এই "কাবুলীওয়ালা" সিনেমাটা । খুব মনে ধরেছিল গল্পটা । কারণ, কোথাও না কোথাও আমার জীবনের সাথে একটু সাদৃশ্য পেয়েছিলাম । যদিও আমার গল্পের পরিণতি ছিল একটু অন্যরকম । আসলে আমাদের সবারই জীবনে এই রকম কেউ না কেউ থাকে । কিন্তু এই ব্যস্ত জীবনে , সমযে়র অভাবে সেইসব মানুষের কথা মনে করার মত ফুরসতটুকু আমাদের থাকে না । তবুও মাঝেমধ্যে তো মনে পরেই যায় । আমার জীবনে অবশ্য এরকম প্রচুর মানুষ আছে । এখনও শ্যামবাজার-হাতিবাগানে গেলে এই মেসবাসী মেয়ের তিন-চার জন কাকু-দাদা তো পেয়েই যাব । কিন্তু এই রকম "ওয়ালা" ছিল একজনই , আমার ছোটোবেলার "ফুচকাওয়ালা" । কিন্তু আমার কাছে "ফুচকাচাচা" । আমার আগের লেখায় তার ব্যাপারে অল্প বলেছিলাম । কিন্তু এইসব মানুষদের নিয়ে ঐটুকু বলে শেষ করে দিলে তা খুবই খারাপ হবে । নিঃস্বার্থভাবে যারা কোনো সম্পর্ক ছাড়াই খুব সহজে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে , রেখে যায় অজস্র স্মৃতি , মন ভাল করে দেওয়া অনেকগুলো মুহূর্ত তাদের ব্যাপারে একটু বেশী বললেই বা ক্ষতি কি ।
আমি ছোটোবেলায় যেখানে থাকতাম , সেটা ছিল বাংলা-বিহার সীমানার কাছাকাছি । তখনও ঝারখণ্ড হয়নি , শুধু বিহারই ছিল । জেলা হিসেবে সে জায়গা বাংলার অধীনে থাকলেও সেখানকার বেশীরভাগই ছিলেন হিন্দীভাষী । প্রায়ই অবাঙালী জায়গাই বলা যেতে পারে । আমিও তাই বাঙালী হয়েও ছোটো থেকে হিন্দীতেই বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতাম । তাই 'ফুচকাওয়ালা'কে 'চাচা' বলতেই বেশী ভালবাসতাম । আর সেও ভীষণ খুশী হত আমার 'চাচা' ডাকে । ভালবেসে চাচাও অবশ্য আমাকে একটা নাম দিয়েছিল , "মুন্নী" । সেই নামে আমাকে আর কখনও কেউ ডাকেনি । দূর থেকে তার এই ডাক শুনেই আমি তার দিকে ছুট লাগাতাম । ছুটে যাব নাই বা কেন , সেই ডাকে যে থাকত খুব আন্তরিকতা । স্কুলের বাইরে সে দাড়াত । রোদ , বৃষ্টি , ঠান্ডা .. যাই হোক না কেন , সে কিন্তু আসবেই । সকালে স্কুলে ঢুকবার আগে থেকে স্কুল ছুটি হওয়ার পরেও , সে যখন আমার বাড়ির সামনে দিয়ে নিজের বাড়ী ফিরত তখন পর্য্যন্ত আমাদের মধ্যে চলত আদান-প্রদান । না-না , শুধু ক্রেতা-বিক্রেতার আদান-প্রদান নয় , চলত স্নেহ ও ভালোবাসারও । আর আমার ফুচকা খাওয়ার তো কোনও শেষ ছিল না বললেই চলে । আমি শেষ বেলা পর্য্যন্ত ছুটতাম তার কাছে ফুচকা খাওয়ার জন্য । তখন ১ টাকায় ৩টে করে ফুচকা পাওয়া যেত । টাকা দিয়ে খেয়েও  "ফাউ" এর আবদার তো থাকতই । শুধুই কি ফুচকা ... তার সঙ্গে মাঝেমাঝেই থাকত তেঁতুলমাখা , শুকনো পাপড়ি , কাঁচাছোলা , ফুচকার তেঁতুলগোলা জল । আর সেই সব কিছুই থাকত বিনামূল্যে । ক্লাস শেষ হলে টিচার বেরিয়ে যেতেই আমরা জানলা থেকে হাত বাড়িয়ে দিতাম ... ফরমাইশ হত তেঁতুল মাখার । চাচা যেন আগে থেকেই সেটা বুঝে যেত , হাত বাড়াতেই জুটে যেত শালপাতায় মোড়া তেঁতুলমাখা । সঙ্গে হাসিমুখে একটা কথা "হমকা মালুম থা মুন্নী" । ছুটির পর প্রায় মারামারি করে তার ঠেলার ওপর গিয়ে হামলে পড়া । এমনভাবে খেতাম , মনে হত যেন কতদিন কিছু খাবার জোটেনি । স্কুলে ছুটির দিনগুলোতে চাচা মার্কেটে বসত । বিকেলে বাড়িফিরতি পথে আমার বাড়ির সামনে দিয়ে খুব বাসন বাজাতে-বাজাতে যেত । মা কে বলে আমি থালা , বাটি আর গ্লাস হাতে রেডী হয়ে থাকতাম । এই ব্যাপারে অবশ্য আমার মা ও কিছু কম যান না । কোনো কারণে আমি সেই সময় না থাকলে বা ঘুমিয়ে পড়লে মা-ই ছুটত ফুচকা নিতে । আমাকে না পেলে চাচা তার মুন্নীর খোঁজ করতেও ভুলত না ।
দূর্গাপূজোর সময় হত আর এক ঝামেলা । আমার বছর ঘুরত দুর্গাপূজো দিয়ে । সারা বছর ধরে পূজোর জন্য টাকা জমা করতাম । আর তার কারণ ছিল একটাই , ঐ চাচার ঠেলার মুখরোচক খাবার ... পানি ফুচকা , স্পেশাল ফুচকা , আলু কাবলী , ঘুগনী চাট । বলতে গিয়ে এখনও আমার জিভে জল চলে আসে । ঐসব খাওয়ার জন্য যে টাকা আমি জমাতাম , তখন তার হিসেবও করতে জানতাম না । এই ব্যাপারটাকে কেন্দ্র করেই ঘরে চলত তুমুল ঝামেলা । আমার বাবা ভাবতেন যে যেহেতু তার মেয়ে হিসেব কষতে পারে না , তাই সে ঠকে আসবে । তাই আমাকে নিয়ে হিসেব বোঝাতে আর মেলাতে বসতেন ... কটা ফুচকা খেয়েছি , সঙ্গে আর কি কি খেয়েছি ওখান থেকে , কত টাকা দিয়েছি , কত ফেরত পেয়েছি , কার কত দাম । সব শেষে হিসেব করতে গিয়ে দেখা যেত যে তার মেয়ে নয় , ঠকেছে বরং সেই 'ফুচকাওয়ালা' , তাঁর মেয়ের চাচা । বাবা পরে টাকা দিতে গেলে চাচা নিতেও চাইত না ।
একদিন চাচা তার ছেলেকে নিয়ে এল । চাচার নাকি বয়স হয়ে যাচ্ছে , আর পারে না ঠেলা টানতে । তার ছেলেকে আমাদের সবাইকে চিনিয়ে দিল । চাচাও সঙ্গে আসত । আমরা গেলে চাচাই ফুচকা বানিয়ে দিত । বাকি সময়টা সে বসেই থাকত । এইভাবেই বেশ কয়েক মাস যাবার পর চাচা আসা বন্ধ করে দিল । মাঝেসাঝে আসত , তাও বেশীক্ষণ না থেকেই চলে যেত । তার নাকি শরীর ভাল থাকে না । চাচা না এলে ফুচকাতে যেন পেতাম না সেই স্বাদ । ফুচকা খাওয়ার ইচ্ছে , আনন্দ কমতে থাকল । চাচার ছেলেকে আমরা "ভাইয়া" বলতাম । ভইয়াও সেইসবই করত যা চাচা করত , তবুও যেন কিছু একটা কম লাগত । চাচার সেই স্নেহ ভরা "মুন্নী" ডাক , আদুরে গলায় খুনসুটি সবকিছুই চাচার শরীরের মত অসুস্থ হয়ে এল । ভাইয়ার কাছে রোজই চাচার খোঁজ করতাম , আর রোজ একই কথা বলত ভাইয়া যে ভাল নেই আরও অসুস্থ হয়ে পরছে । একদিন ভাইয়াও এল না । কি অদ্ভুতভাবে ফুচকার ঠেলাটা সেদিন দেখতে না পেয়ে কেমন একটা ভয় হয়েছিল , প্রথমবার হল ওরকম । কয়েকদিন পর ভাইয়া ফিরতেই ছুটে গেছিলাম তার না আসার কারণ জানতে আর সঙ্গে চাচার খোঁজ নিতে । চাচা নাকি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছিল । তারপর থেকে মাঝেমধ্যেই ঐ ফুচকার ঠেলাটা আসত না , যেন সেও তার মালিকের জন্য চিন্তিত । যতদিন ওখানে ছিলাম এইভাবেই দেখে গেলাম । তারপর বাবার ট্রান্সফার হয়ে গেল আর আমরাও নতুন জায়গায় চলে গেলাম । বন্ধুদের কাছে পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছিলাম যে 'ফুচকাওয়ালা' নাকি চিরবিদায় নিয়েছে । বিশ্বাস হয়নি , আজও হয়না । মনে হয় যেন ভূল খবর শুনেছিলাম বা ওরা ভূল খবর পোয়েছিল । সেখানে গেলে হয়তো আজও "ফুচকাওয়ালা"কে ঐভাবেই ঠেলার ওপারে দাঁড়িয়ে থেকে ফুচকা বিক্রি করতে দেখব । সেও তার মুন্নীর জন্য অপেক্ষা করে আছে হয়তো ।

Sunday 29 January 2017

মেলা vs Fair



        শীতকালে চারিদিকে অনেক মেলা চলছে । তার মধ্যে ট্রেড ফেয়ার অন্যতম । আমার কাছে এ যেন অন্যই এক জগৎ । দেশী জিনিসপত্রের সাথে সাথে বিদেশী জিনিসেরও প্রচুর সম্ভার । অবশ্য আমরা মেলার শেষের দিকে গেছিলাম , আমরা যে দিন যাই তারপরের দিনই ছিল মেলার শেষ দিন । ততদিনে অনেক জিনিস নাকি কমে এসেছে । যদিও আমার একটুও তা মনে হল না । দেখে মনে হচ্ছিল যেন সবেমাত্র শুরু হয়েছে । কোথাও আড়ম্বড়ে একটুও খামতি নেই , জিনিসপত্রের কোনো অভাব নেই । প্রতিটা স্টলে ঠাসা জিনিস । সারি-সারি জামাকাপড় , তার ওপর চকচকে জড়ির কাজ করা । আর সেই সব চকচকে কাজের ওপর পড়ছে জোড়ালো আলো । কোথাও আছে চোখ ধাঁধানো রকমারি গয়না , বিভিন্ন রঙবেরঙের পাথর আর পুঁথির তৈরী গয়নাও তার মধ্যে বিশেষ আকর্ষণ । আবার কোথাও আছে শৌখীন জিনিসপত্র । আছে আসবাবপত্র , রোজকার কাজে ব্যবহৃত ছোট থেকে বড় জিনিস । মানে বলা যেতে পারে সমস্ত পৃথিবীর যাবতীয় সমস্ত কিছু ঐ এক জায়গতেই আমরা পেয়ে যাচ্ছি । বিদেশী জিনিস কিনতে আমাদের কাটতে হচ্ছে না প্লেনের টিকিট , বানাতে হচ্ছে না ভিসা । সব কিছুই হাতের কাছে চলে এসেছে । আর সেই সমস্ত জিনিসের দাম হল আকাশ ছোঁয়া । যদিও কোথাও কোথাও দর দাম করে সেই দাম একটু আধটু কমানো যাচ্ছে । যাই দেখি , তাই যেন পছন্দ হয়ে যায় । কিন্তু দাম শুনলেই ব্যস্ । তারই মধ্যে কি অসম্ভব ভীড় , কত লোক এসেছে , আর তারা কত কি কেনাকাটা করছে সবাই । সেরকম ভাবেই সমান তালে চলছে খাওয়া-দাওয়া । ওখানেই একটা বড় জায়গায় "ক্যাফেটেরিয়া" করেছে , একই ছাদের নিচে সব সুযোগ সুবিধে । কিছু লো টিস্যু পেপার দিয়ে যাচ্ছেন যারা খেতে বসেছেন পাত পেরে । আর সেখানেও আছে হরেক রকমের খাবার ... ভারতের সমস্ত জায়গার লোভনীয় আর সুস্বাদু খাবার আছে সেখানে । আছে হাত ধোয়ারও আলাদা ব্যবস্থা ।  তাছাড়াও আছে অন্যান্য সব সুবিধে , যেমন বিস্তর জায়গা জুড়ে বসার সুবিধে , শৌচালয় সুবিধে ।
        তাতেও এমন  কিছু নাক উঁচু মানুষজন দেখলাম , যারা ভীষণই অসন্তুষ্ট । চোখে মুখে বিরক্তি , সমস্ত জিনিস দেখেই নাক সিঁটকোচ্ছেন , এমন হাবভাব যেন ঐ সমস্ত মূল্যবান জিনিসও তাদের জন্য পর্যাপ্ত নয় । অথচ তাদেরই আবার দেখলাম যে কেনাকাটার কোনো কমতি নেই । প্রায় সমস্ত স্টল থেকেই কিছু না কিছু কিনে চলেছেন । ক্যাফেটেরিয়ার খাবার দেখে ভীষণভাবে নাক মুখ কুঁচকে বোঝাতে চাইলেন যে ঐসব খাবার তাদের স্টেটাসের সঙ্গে একদমই বেমানান । পরক্ষণেই আবার তা খেতেও ছাড়লেন না । শৌচালয়ও ব্যবহার করলেন তারা অনেক কিছু খুঁত বের করার পর । এত কিছু সুযোগ সুবিধের মধ্যেও তারা অসন্তুষ্টই থেকে গেলেন ।
        আমি মেলার সবকিছু দেখে বেশ আনন্দই পাচ্ছিলাম আর মুগ্ধ চোখে দেখে যাচ্ছিলাম । চোখের পলক ফেলতেও তখন আমার একটুও ইচ্ছে নেই । কারন , এতদিন আমার কাছে মেলার ছবিটাই ছিল সম্পূর্ণ আলাদা । ছোটো থেকে আমার কাছে মেলা বলতে ছিল বছরের দুটো মেলা , দুর্গাপূজার মেলা আর শীতের শেষের শিশুমেলা । পুজোর মেলাতে বিশেষ আকর্ষণ তখন মেলাতে বসা একখানা গয়নার দোকান , যেখানে থাকত গ্রামের মানুষের হাতের তৈরী কয়েকটা মালা আর দুল । হাতের চুরি পর্য্যন্ত সেই মেলায় পাওয়া যেত না । দোকানগুলোতে থাকত না কোনো জাঁকানো আলো । জ্বলত একটা টিমটিমে আলো , সেই আলোয় জিনিসপত্র ঠিকভাবে দেখাও যেত না । ওগুলোকে দোকান বললেও ভুল হবে , গুমটি বলাই ভাল । হাতে গোনা ৬-৭ টা ঐ রকম গুমটি । কেউ বাচ্চাদের জন্য প্লাস্টিকের খেলনা , কেউ গয়না , কেউ বিভিন্ন পোস্টার , কেউ বা মাটির তেরী খেলনা আবার কেউ বিভিন্ন ধরনের মূর্তি নিয়ে বসত । মেলা থাকত ঠিক চার দিন । সেই চারদিনের জন্য সারা বছর ধরে টাকা জমাতাম , আর ঐ চারদিনের মধ্যে সমস্ত জমানো টাকা শেষ হয়ে যেত । ক্লাব ঘরের সঙ্গে লাগোয়া পুজো মন্ডপ , সেই মন্ডপ ঘিরে তৈরী প্যাণ্ডেল । প্যাণ্ডেলের বাঁদিক করে ঐসব গুমটী আর ডানদিকে শুধু খাবারের দোকান .... মোগলাই পরোটা , ছোলে বটোরে , ঘুগনী , বিভিন্ন চপ আর মিষ্টি । অবশ্য বছর পেরোনোর সাথে সাথে আরো অনেক রকমের খাবারের ভ্যারাইটিজ যোগ হয় , ঢোসা, ইডলী , চাউ এইসব । কিন্তু এইসবের থেকেও বেশী দৃষ্টি আকর্ষন করত ক্লাব ঘরের ঠিক পাশেই একটা ঠেলাওয়ালা , ফুচকা নিয়ে । আমার জমিয়ে রাখা টাকা যেখানে শেষ হত , সেই "ফুচকাকাকুর" ঠেলা । স্কুল চলাকালীন স্কুলের সামনেও বসত সে । আমি মোটামোটি যাকে বলে তার "ডেইলী কাস্টোমার" । অনেক সময় যখন আমি স্কুল ফাঁকি দিতাম বা যখন সে একটু দেরী করে বাড়ী ফিরত, আমার বাড়ীর সামনে দিয়ে বেশ জোরে জোরে তার ঠেলার ঘন্টি বাজাতে বাজাতে । মনে পড়ে এখনও আমার তখন আমি থালা , বাটী আর গ্লাস হাতে ছুটতাম । আর বাইরে গিয়ে দেখতাম ফুচকাকাকু দাঁড়িয়ে আমার অপেক্ষা করছে , যেন সে আমার ছুটে যাওয়া টের পেয়েছে । ঠিক যেন "কাবুলীওয়ালা" গল্পের মত "ফুচকাওয়ালা"ও তার "মুন্নী"রূপী "খোঁকি"র অপেক্ষা করছে । মেলাতেও সে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত । টাকা দিয় খাওয়া ছাড়াও সেখানে উপরী পাওনাটা বেশী হয়ে যেত , বিনা দামে বেশ কতকগুলো ফুচকা , তার তেঁতুলের থলি থেকে তেঁতুল , কখনও এমনিই কখনও বা তা লঙ্কা নুন দিয়ে মাখানো । কত আন্তরিকতা তার মধ্যে , কত স্নেহ জড়ানো রয়েছে তাতে । এখনও মনে পড়লে গলার কাছটা কেমন যেন ব্যথা হয় , চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে । বাকি খাবারের দোকানের দাদা-কাকুরও ছিল প্রায় চেনা পরিচিতি । যেখানেই যেতাম আমরা বন্ধুরা দল মিলে , সবাই বেশ সস্নেহে আপ্যায়ন করত ।
        আর এক মেলা হল শিশুমেলা । সেটা অবশ্য বেশ খানিকটা দূরে হত । সেখানে যেতে হলে একা বা বন্ধুদের সাথে যাওয়ার কোনো উপায় নেই । বড়দের ছাড়া সেখানে যাওয়া আমাদের এলাকার বাচ্চাগুলোর পক্ষে সম্ভব ছিল না । তাই বড় ছোট সবাই মিলে হইহুল্লোর করে আমরা সেখানে যেতাম । দেখে মনে হত যেন পিকনিকে যাওয়া হচ্ছে । আর সেই মেলার বিশেষ আকর্ষণ ছিল নাগরদোলনা আর হেলিকপ্টার , যেগুলোয় বসার জন্য আমরা মরিয়া হয়ে উঠতাম । এখনও মনে পড়ে সেই দিনগুলো .... বাবার হাত ধরে হেলিকপ্টারে চাপা আর নামবার সময় এত মাথা ঘুরত যে আমাকে বাবা কোলে করে নিয়ে নামত ।  নাগরদোলনায় একেবারে পাঁচবারের টিকিট কেটে উঠতাম , সেখানে অবশ্য বন্ধুদের সাথে । যখন ওপর থেকে নিচের দিকে দোলনাটা নামত , পেটের ভিতর কেমন যেন কাতাকুতুর মত হত । তবুও দোলনার কাকুকে আরও জোরে ঘোরাতে বলতাম আর কাকু হাসিমুখে একটু বাড়িয়েই আবার কখন কমিয়ে দিত যাতে আমাদের অসুবিধে না হয় আর আমরা তা বুঝতেও পারতাম না । আর মা নীচে থেকে মা ভয়মাখা চোখে পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকত আমার দিকে আর আমি দোলনা থেকে মাকে আশ্বাস দেওয়ার চেষ্টা করতাম । কিন্তু দোলনা থেকে না নামা পর্য্যন্ত মায়ের শান্তি হত না । তারপরই হইহই করে খাবারের দোকানে হামলা । সেখানেও ঐ একই দুর্গাপূজোর মেনু , আর একটু বেশী বলতে চাউমিন , এগরোল , চিকেন রোল । তখন তো টিস্যু পেপার দেওয়ার লোক তো দুরের কথা , টিস্যু পেপারই কেউ চিনতাম না । তাই খাওয়া হলে ওদের খোলা জলের ড্রাম থেকেই জল বের করে হাত মুখ ধুয়ে রুমালে মুছে নিতে হত । খাওয়া সেরে চুরি , মালা , ফিতে , আরও ঐরকম টুকটাক জিনিস কিনেই বাড়ির পথ ধরতে হত । কারণ , শৌচালয়ের পরিষ্কার কোনও ব্যবস্থা ছিল না ।
ঐসব মেলাতে ছিল না এত জাঁকজমক , ছিল না এত আড়ম্বর , ছিল না এত রকমারি জিনিস , এত চোখ ধাঁধানো ব্যাপার , এত সংগঠিতভাবে সাজানো .... কিন্তু ছিল সবাইকে খুশি করার সামর্থ্য , অল্পেতে সন্তুষ্ট হওয়ার অভ্যেস , খুব সহজেই কাউকে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা । সেই সব মেলায় হত মিলন , তৈরী হত নতুন সম্পর্ক , পুরনো সম্পর্ক হয়ে উঠত আরও দৃড় । এই ট্রেড ফেয়ার তার নামকে সার্থক করে , কিন্তু মেলা নয় । a trade but it's not fair . এখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক হয় কেবলমাত্র টাকার বিনিময়ে , ক্রেতা আর বিক্রেতা , সেখানে দু'পক্ষ থেকেই আন্তরিকতা বলে কিছু থাকে না । অবশ্য এখন এইরকম না হলে চলেও না হয়ত । অত চাকচিক্যপুর্ণ মেলা ঘুরে খুব ভাল লাগার কথা ছিল আমার , কিন্তু ঠিক হতে পারলাম না । মেলা vs fair এর পার্থক্যটা যেন প্রতি মুহূর্তে অনুভব করছিলাম ।

Monday 5 December 2016

Sharodiya rod

কয়েক দিন ধরেই খুব মেঘ আর বৃষ্টি হয়ে চলেছিল । আর যখন একটু রোদের ছটা দেখতে পাচ্ছিলাম তখন মনে হচ্ছিলো জানলার রোদটা কেমন যেন সরে গেছে । কিন্তু এত কাজের ফাঁকে সেটা ভালো করে লক্ষ্য করার সময়ই হয়ে উঠছিল  না । প্রথমে ভেবেছিলাম হয়তো জানলার রোদের আসার তখনো  সময় হয়নি । আবার কখনও মনে হচ্ছিল যে হয়তো জানলায় রোদ এসে পড়ার সময় পেরিয়ে গেছে । কিন্তু আজ সকাল থেকেই দেখি এক গাল হাসি নিয়ে আকাশ ঝকঝকে করে সূর্য দেবতা হাজির হয়েছেন । তাই দেখে বেশ আনন্দিত হয়ে আলমারি থেকে আমার বিয়ের বেনারসীগুলো আর তার সঙ্গে আরো কিছু জামা কাপড় নিয়ে ছাদে ছুটলাম , রোদে দেওয়ার জন্য ।

রোদটা আমার গায়ে পড়তেই কেমন যেন একটু মনে হল । প্রথমে খেয়াল করিনি , মনে হল এত বর্ষার পর রোদ উঠেছে বলেই হয়তো আমার অন্য রকম লাগছে আজকের সূর্য দেবতার হাসিকে । যেদিকে সচরাচর সূর্য দেবতাকে দেখতে আমি অভ্যস্ত , আজ সেই দিকে তিনি নেই । কিন্তু কিছুক্ষন বাদেই বুঝলাম এ যে -সে রোদ নয় , এ হচ্ছে আমাদের মন খুশি করে দেওয়ার রোদ । সারা বছর ধরে আমরা বাঙালীরা অধীর আগ্রহে যে রোদের অপেক্ষায় থাকি , এ হচ্ছে সেই রোদ । শুধু বাঙালী কেন , আজকাল জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবাই এই রোদ এর আনন্দে মেতে ওঠে । এ হলো আমাদের সবার প্রিয় শারদীয়া রোদ

শারদীয়া রোদ এসেছে , ভেবেই আনন্দে মন নেচে  উঠলো । নিজের মনেই একা-একা দাঁড়িয়ে হেসে উঠলাম । জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখলাম ভালো করে । এই রোদ এর সঙ্গে এক সোনালি আভা মিশে আছে । যেন হলুদ আর সোনালী রং এর  দুই শিশু হাত ধরাধরি করে এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে । আর সেই খেলার ছলে গাছপালা-ঘরবাড়ির প্রত্যেকটা কোণ ছুঁয়ে যাচ্ছে । নিজেদের রঙে রাঙিয়ে দিচ্ছে , আর তারপরই খিলখিল হাসিতে হেসে উঠছে দুজনেই । কি অপরূপ সেই দৃশ্য । আমি শুধুই মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেই সব দেখছি আর মনে হচ্ছে যেন আমার মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা শিশু তাদের সঙ্গে খেলতে চাইছে , ছুটে  যেতে চাইছে তাদের হাত ধরে । আবার নিজের মন-শিশুর কথা বলতেই মনে পড়ে  গেল সেই ছেলেবেলার কথা । এই রোদ দেখে যত আনন্দ পেতাম ,ততটা দুখীও হতাম । পুজো আসার এক তুমুল আনন্দ , আর তার সঙ্গেই জড়িয়ে থাকত পরীক্ষার সময় হয়ে আসার এক ভয় ,দুঃখ ,কষ্ট ,হতাশা । মনে হত  যেন শুধু আনন্দের রোদকে আঁকড়ে ধরে রাখতে পারলে বেশ ভালো হত । আমার পড়ার বিছানার পাশেই জানলা ছিল । ঠিক জানলার পাশেই ছিল একটা পেয়ারা গাছ , কত রকমের পাখি আসত আর আমাকে কত কথা বলে যেত । কেউ কেউ আবার গান ও শুনিয়ে যেত । আমি তাদের কোনোকিছুই ঠিক বুঝতে পারতাম না । কিন্তু এই শরৎকালে তাদের ভাষা যেন আমি বুঝতে পারতাম । মনে হত তারা যেন শারদ শুভেচ্ছা জানাতে এসেছে । মাঠে কত কাশফুল ফুটেছে সেটা জানাতে এসেছে । চারদিকের ম-ম করে ওঠা শিউলি ফুলের গন্ধে তারা যে মাতোয়ারা হয়ে উঠেছে সেটা জানাতে এসেছে । তার সঙ্গে হাত ধরে নিয়ে এসেছে দুস্টু শারদীয়া রোদকে ,আমার ঠিকানা চিনিয়ে দিয়ে । মন ভরে সেই মিষ্টি শারদীয়া রোদকে দেখতাম আর তার সঙ্গে সেই পাখিদের কতই না গান-গল্প শুনতাম । তাদের ওই কলধ্বনিতে আমি যেন ঢাকের আওয়াজ শুনতে পেতাম । চোখের সামনে ভেসে উঠত হাওয়ায় দোল খেতে থাকা মাঠ ভর্তি কাশফুল। আর গন্ধ পেতাম শিউলি ফুলের । মনে হত সেই পেয়ারা গাছের ফাঁক দিয়ে শারদীয়া রোদ হাতছানি দিয়ে আমায় ডাকছে । সে আমার সাথে খেলতে এসেছে । ভীষণ দুস্টু , একদম পড়াশোনা করতে দেবে না সে । কি রকম খিলখিল করে হাসছে আমার ওপর । সে উন্মুক্ত , খোলা আকাশে যখন যেখানে খুশি যেতে পারে । নেই কোনো পরীক্ষা আর পড়াশোনার বালাই । "ইশ , এবার খুব রাগ হচ্ছে আমার ওর ওপর "। আমার সঙ্গে খেলতে এসে আমাকে নিয়েই ঠাট্টা করছে । রোজ সকালে আসছে আজকাল , দুপুরেও আসছে রোজ । আর আমি অপেক্ষা করতাম পরীক্ষা শেষ হওয়ার । আর মনে করে নিতাম আমার নতুন জামাকাপড় গুলোকে । ঠিক করে নিতাম পুজোর কোন দিন কোনটা পড়ব। সঙ্গে ম্যাচিং গয়নাও । কিন্তু পরীক্ষা খারাপ দিলে সব প্ল্যানিং ভেস্তে যাবে । এই ভেবে একটু ভয়  পেতাম ঠিকই , কিন্তু শারদ রোদ এর সম্মোহনে পরীক্ষার ভয় ভুলে গিয়ে আবার নিজের কল্পনার দেশে চলে যেতাম । কত কি ভাবতাম আর ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়তাম বই এর ওপর ।

ঘুম ভাঙত এক মিষ্টি নারী কণ্ঠে । খুব আদর করে,মাথায় হাত বুলিয়ে ,কে যেন কানের কাছে এসে বলত "এবার উঠে পর " । ঘুমের ঘোরে মনে হত যেন মা দূর্গা এসেছেন ,আমাকে সেই দুস্টু শারদীয়া রোদের সাথে ভাব করিয়ে দিতে । চোখ খুলে দেখি আমার মা দাঁড়িয়ে আছেন আর আমাকে আবার পড়তে বসতে বলছেন । বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি দুস্টু রোদ তখনও খেলা করে চলেছে । আমায় আবার হতাশ মনে বই এর মধ্যে মুখ গুঁজলাম । হঠাৎ কেউ যেন পেছন থেকে ডেকে উঠল । পিছন ফিরতেই দেখি আরেকটা আমি জানলার সামনে দাঁড়িয়ে , কিন্তু তার হাতে কোনো বই নেই, নেই পরীক্ষা দেওয়ার কোন চিন্তা । আমি এখন সেই আলমারির জামাকাপড় হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে । এখনও সব রোদে দেওয়া শেষ হয়নি । আনন্দের ঘোর কাটিয়ে ফিরে এলাম বাস্তব জগতে । আর একটু হাসিই পেল নিজের ওপর । আমি বড় হয়ে গেলাম , কাজের ধরনও বড় হয়ে গেল। কিন্তু শারদীয়া রোদ চিরকাল সেই একই রকম থেকে গেল ,সেই একই দুস্টু শিশু । ছোটবেলায় আমাকে পরীক্ষার সময় যেভাবে নিজের মায়াজালে জড়িয়ে ফেলত, এখনো ঠিক সেই একইরকম ভাবে আমার সাথে খেলা করছে । ভীষণ দুস্টু এই শারদীয়া রোদ ,তবু সারাবছর অপেক্ষা করে থাকি এর জন্যে ।

আর সময় নেই, অনেক কাজ পরে আছে । ছুটে গেলাম আবার আমার নিত্য নৈমিত্তিক জীবনে ।